** এনবিআরের বিশেষ আদেশ জারির ১৫ মাস আগের ভ্যাট, তবুও বাংলালিংক মানছে না
** একাধিক চিঠি দেয়া হলেও বাংলালিংক ভ্যাট পরিশোধে ১২ বছর পার করে দিয়েছে
** বিটিআরসি ভ্যাট পাবে-এনবিআর থেকে মতামত দেয়া হয়েছে, আবার মতামত চেয়েছে বিটিআরসি
আয় করা শেষ এক যুগ বা ১২ বছর আগে। সেই আয়ের অংশ বা রেভিনিউ শেয়ারিংও শেষ। কিন্তু সেই রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর প্রায় ৪২ কোটি টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। দেশের বেসরকারি মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানি বলছে, রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর ভ্যাট হলো দ্বৈত কর। এই যুক্তি তুলে উচ্চ আদালত পর্যন্ত কোম্পানি গেছে। কিন্তু আদালত বলছে, এই ভ্যাট বাংলালিংককে দিতে হবে। তবুও কোম্পানি এক যুগ আগের সেই ভ্যাট পরিশোধ করছে না। মোবাইল অপারেটরদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলছে, এই ভ্যাট কোনোভাবেই দ্বৈত কর নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে আদেশ জারি করেছে, সেই আদেশের আগেই এই ভ্যাট। ফলে বাংলালিংককে এই ভ্যাট দিতেই হবে। বছরের পর বছর চিঠি দেয়ার পরও বিটিআরসির আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না বাংলালিংক। তবে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ বলছে, আইন মেনে তারা বিষয়টি সমাধান করবে।
বিটিআরসি সূত্রমতে, মোবাইল অপারেটরগুলো গ্রস আয়ের ওপর বিটিআরসির সঙ্গে একটা অংশ রেভিনিউ শেয়ারিং করে। বেসরকারি চারটি মোবাইল অপারেটরের মধ্যে বাংলালিংক অন্যতম। এই কোম্পানি ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত যে রেভিনিউ শেয়ারিং করেছে, তার ওপর ৪২ কোটি ৫৮ লাখ ১৬ হাজার ১৭১ টাকা ভ্যাট বিটিআরসিকে পরিশোধ করেনি। এই ভ্যাট পরিশোধের জন্য সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৫ জুন বিটিআরসি বাংলালিংককে চিঠি দেয়। কিন্তু বাংলালিংক এনবিআরের ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট জারি করা দ্বৈত কর নীতি আদেশ অনুযায়ী এই ভ্যাট প্রযোজ্য নয় বলে বিটিআরসিকে জানান। অথচ ওই আদেশের আগের রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর এই ভ্যাট দাবি করছে বিটিআরসি।
এনবিআরের ওই বিশেষ আদেশে বলা হয়েছে, যেহেতু মোবাইল অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে যে সেবামূল্য আদায় করেন, তার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধের পর প্রাপ্ত নিট অর্থ থেকে রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ দ্বিতীয় প্রজন্মের লাইসেন্স ব্যবহারের শর্তানুযায়ী বিটিআরসিকে প্রদান করতে হয়। যেহেতু রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে পরিশোধযোগ্য রাজস্বের ওপর মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১-এর বিধি ১৮(ঙ) অনুযায়ী বিটিআরসি কর্তৃক ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট উৎসে আদায় বা কর্তনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে দ্বৈতকর আরোপিত হয়। সেহেতু দ্বৈতকর পরিহারের লক্ষ্যে এনবিআর মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ১৪-এর উপধারা (২)-এ ক্ষমতাবলে বিটিআরসিকে দ্বিতীয় প্রজন্মের লাইসেন্স ব্যবহারের শর্তানুযায়ী রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে মোবাইল অপারেটর কর্তৃক প্রদত্ত প্রদেয় রাজস্ব থেকে উৎসে মূসক কর্তন বা আদায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করল।
অপরদিকে বিটিআরসি এই ভ্যাট পরিশোধে ২০২৪ সালের ২৫ জুন বাংলালিংককে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগ শুনানি শেষে বিটিআরসির পক্ষে রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলালিংককে এই ভ্যাট দিতে হবে। এই ভ্যাট পরিশোধে ২০২৩ সালের ২২ জুন ও ২৪ ডিসেম্বর বাংলালিংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে কর্তন করা ভ্যাট বাংলালিংককে পরিশোধের জন্য ২০২৪ সালের ৫ জুন বিটিআরসি থেকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলালিংক ভ্যাট পরিশোধে সাড়া দেয়নি। পরে ১০ জুন এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলালিংক বিটিআরসিতে একটি আবেদন করে। আবেদনে এনবিআরের ২০১২ সালের ১২ আগস্ট জারি করা বিশেষ আদেশ অনুযায়ী দ্বৈত করনীতিতে রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়।
তবে নথিপত্র ও ওই আদেশ বিশ্লেষণ করে বিটিআরসি বলছে, রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর ভ্যাট বা মূসক হিসেবে পাওনা এনবিআরের আদেশ জারির পূর্ববর্তী বা আগের ১৫ মাস সময়ের (২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত)। ফলে বাংলালিংকে আবেদনপত্রে দ্বৈত করের যে দাবি করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। সেজন্য বাংলালিংক কর্তৃপক্ষকে ভ্যাট হিসেবে ৪২ কোটি ৫৮ লাখ ১৬ হাজার ১৭১ টাকা পরিশোধ করতেই হবে। এই ভ্যাট পরিশোধে বাংলালিংককে সাত দিনের সময় বেঁধে হয়। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তবে সময় শেষ হলেও বাংলালিংক কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। অর্থাৎ এক যুগ পরও বিটিআরসিকে পাত্তা দিচ্ছে না বাংলালিংক।
অপরদিকে বিটিআরসি নিরুপায় হয়ে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে, যাতে এনবিআর আদেশ জারির আগে করা রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর ‘ভ্যাট’ প্রযোজ্য হবে কি না, সে বিষয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিটিআরসির চিঠি দেয়ার পাঁচ মাস পরও এনবিআর থেকে কোনো মতামত দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে ৩ জানুয়ারি আবার মতামত চেয়ে এনবিআরকে বিটিআরসি চিঠি দিয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনবিআর আদেশ জারির আগের হলে অবশ্যই বাংলালিংকে এই ভ্যাট দিতে হবে। বিটিআরসির চিঠি অনুযায়ী, আদালতও তাই বলেছেন। এরপরও ভ্যাট না দিলে বিটিআরসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। বিটিআরসি আমাদের যে চিঠি দিয়েছে-আমরা আমাদের আদেশের সঙ্গে মিলিয়ে বা বিশ্লেষণ করে একবার জবাব দিয়েছি। এখন আবার চিঠি দিয়েছে, আমরা আবার একই মতামত দেব। কোম্পানি যুক্তি দেখায়, আদেশ জারির পর যদি এই ভ্যাট দিতে না হয়, তাহলে আদেশ জারির আগেরগুলোয় ভ্যাট হবে কেন? তাদের দাবি, এটা ট্যাক্স অন ট্যাক্স বা দ্বৈত কর। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলালিংক সবসময়ই দেশের আইন, নীতিমালা ও বিচার প্রক্রিয়া মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আইনি ব্যাখ্যা প্রদান করব। আমরা বিশ্বাস করি, বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনি পদ্ধতি মেনে সমাধান করা হবে।’
**বাংলালিংকের ডেটা কিনলেই ‘গায়েব’
**ভ্যাটের ৫৮ কোটি টাকা দিতেই হবে বাংলালিংককে
**বাংলালিংকের ২ হাজার টাওয়ার কিনল সামিট
**‘তরঙ্গ চার্জে’ ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে বাংলালিংককে
**মূসক দিচ্ছে না বাংলালিংক, সাড়া দেয়নি তাগিদপত্রে
**বাংলালিংক তিন বছর ধরে হোল্ডিং ট্যাক্স দিচ্ছে না