ভূমিসেবায় স্থবিরতা: সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ

গত বছরের নভেম্বর থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে ভূমিসেবায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দিনের পর দিন ভূমি অফিসে গিয়ে নামজারি, খাজনা পরিশোধ এবং খতিয়ান বা ডিসিআর পাওয়া যাচ্ছে না। সার্ভার ত্রুটির অজুহাতে জমি নিবন্ধন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, কিছু মহল ইচ্ছাকৃতভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। যদিও মন্ত্রণালয় মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

সরকার বাজেট ঘাটতির জন্য শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়াচ্ছে অথচ সরকারের পাওনা ভূমিকর সরকারকে দিতে পারছে না জনগণ। এতে একদিকে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। সরকারের ভিতর আরেকটি সরকার কাজ করছে বলে মন্তব্য করছেন ভুক্তভোগীরা।

বিভিন্ন ভূমি অফিসে সরেজমিনে দেখা গেছে, নামজারি ও খাজনা আদায় বন্ধ থাকার কারণে মানুষ জরুরি প্রয়োজনেও জমি বিক্রি করতে পারছে না, যেমন—সন্তানকে বিদেশ পাঠানো, মেয়ের বিয়ে বা চিকিৎসার জন্য। ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, দলিল রেজিস্ট্রেশনে খাজনা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায়, খাজনা না পরিশোধ করতে পারায় অনেক জায়গায় দলিল রেজিস্ট্রেশনও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নামজারি ও খাজনা না হলে জমিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ পাওয়া যায় না, ব্যাংক ঋণ নেওয়া সম্ভব হয় না। একই কারণে বহু নির্মাণকাজও থমকে গেছে, যার ফলে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা উপখাত, যেমন—রড, সিমেন্ট, শ্রমিক, রং, প্রকৌশলী, পাথর, টাইলস, বিদ্যুৎসামগ্রী ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সারা দেশে ভূমিসেবায় ‘হযবরল’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ জানিয়েছেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কিছু সমস্যা ছিল, তবে বর্তমানে কোন সমস্যা নেই। সার্ভার আপডেট করা হচ্ছে এবং মার্চের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার আশা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পূর্বাচল এলাকায় রাজউকের প্লটের নামজারি বন্ধ রাখা হয়েছে, কারণ সেখানে কিছু অনিয়ম এবং খতিয়ানে ভুল রয়েছে। ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে আগামী এক বছরের মধ্যে সবকিছু সিস্টেমে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন জানিয়েছেন, সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই খাজনা না নেওয়া বা নামজারি বন্ধ করার বিষয়ে। তবে রাজউকের প্লটগুলোর দাগ-খতিয়ান না থাকায় সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগুলো আটকে দিচ্ছে। সফটওয়্যার পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূমিসেবা সহজ করার জন্য পূর্বের একাধিক ম্যানুয়াল সফটওয়্যারকে একটিতে উন্নীত করা হয়েছে, যা সার্ভারের খরচ কমাবে। তবে সফটওয়্যারের কিছু ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে, যেগুলোর সমাধান চলছে। ডিসেম্বরের তুলনায় পরিস্থিতি এখন ভালো হলেও, মার্চে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন সম্ভব হলে সমস্যাগুলি সমাধান করা যাবে, তবে এর নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ৩০% সমস্যা সফটওয়্যারের কারণে, বাকিটা ইন্টারনেটসহ অন্যান্য কারণে, এবং সফটওয়্যারে এআই পদ্ধতি ব্যবহৃত হওয়ায় ছোটখাটো ভুলত্রুটি হলে অটোমেটিকভাবে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

রাজধানীর ডুমনি ভূমি অফিসে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, অনেক সেবাপ্রার্থী দিনের পর দিন নামজারি ও খাজনা পরিশোধের জন্য এসে ঘুরছেন। কর্মকর্তারা সেবাপ্রার্থীদের পাশে বসিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসছেন, কিন্তু পরবর্তীতে সার্ভার সমস্যা দেখিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেককে সরাসরি দরজার বাইরে থেকেই সার্ভার ত্রুটির অজুহাত দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কাজের অভাবে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।

রেহানা পারভীন নামের একজন ক্যান্সার রোগী জানান, তার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু জমি বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ করতে না পারায় জমি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, যদি সরকার কোনো এলাকার ভূমিসেবা বন্ধ রাখে, তবে তার কারণ জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে জানানো উচিত। একইভাবে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংবাদকর্মীদের পাঠানো খবরে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, বগুড়া, নাটোর, মেহেরপুর, হবিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট, কুতুবদিয়া সহ সারা দেশে ভূমিসেবার দুরবস্থা প্রকট হয়ে উঠেছে।

বরিশালে সার্ভার জটিলতার কারণে জমির খাজনা আদায় ৮০% কমে গেছে। চরবাড়িয়া ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. শাহিন আলম জানিয়েছেন, গত আড়াই মাসে মাত্র ২০% খাজনা আদায় হয়েছে। যারা বিদেশে রয়েছেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে পারেন না। একাধিক মালিকের খতিয়ান থাকলে আংশিক খাজনা দেওয়া যায় না, এবং আবেদনকারী টাকা পরিশোধ করলেও অনলাইনে দাখিল প্রাপ্তি সম্ভব হচ্ছে না।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় সদ্য বদলি হওয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইয়াসীন সাদেক জানান, নামজারিসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জমির পরিমাণ ও দাগের খতিয়ান শূন্য দেখানো হচ্ছে, এবং সাফ কবালা অটো আসছে না। আদেশপত্রে কেস নম্বর উল্লেখ করা হচ্ছে না, এবং একাধিক দাগে জমি না থাকলে সেই দাগ বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া, একাধিক নামের ক্ষেত্রে হিস্সা সংশোধন সম্ভব নয় এবং নাগরিক আইডিতে কিছু তথ্য দেখা যাচ্ছে না। ভূমি উন্নয়ন কর নেওয়া যাচ্ছে না, এবং একই খতিয়ানে একাধিক আবেদন করা হলে বাতিলও হচ্ছে না। খতিয়ান নম্বর এলে জমির এন্ট্রি সঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না।

নাটোরেও ভূমি উন্নয়ন কর, নামজারি ও জমি রেজিস্ট্রেশন এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। ফুলবাগান এলাকার বাসিন্দা আলিফ হোসেন বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে ভূমিকর দিতে ঘুরছি। এসে খালি হাতে ফিরে যাই। সার্ভার নাকি কাজই করে না। ’ হুগলবাড়িয়ার কৃষক আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘জমি বিক্রি করব, সেজন্য খারিজের আবেদন করতে এসে শুনি সার্ভার কাজ করছে না। তিন দিন এসেও কাজ করতে পারিনি। ’

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ভাটি শৈলজুড়া গ্রামের বাসিন্দা শামীম আহমেদ দুই মাস ধরে ২৪ শতক জমি বিক্রির জন্য ভূমি অফিসে ঘুরছেন, কিন্তু সার্ভার জটিলতার কারণে নামজারি করতে পারছেন না। তিনি বলেন, তার ভাগনেকে সার্বিয়া পাঠানোর জন্য ১০ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন এবং বাকি ৬ লাখ জমি বিক্রি করে পরিশোধ করার কথা ছিল। শায়েস্তাগঞ্জ ভূমি অফিসের নাজির চয়ন কুমার দাস জানান, সার্ভার জটিলতার কারণে তাদের এলাকায় ৪৩টি মৌজার মধ্যে কোনটিতেই নতুন নামজারি করা সম্ভব হচ্ছে না।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের চাপড়া মৌজার একটি জমির নামজারি আবেদন ডিসেম্বরের শুরুতে জমা দেওয়া হয়। তবে সার্ভার সমস্যার কারণে আবেদনটি ১২ জানুয়ারি গ্রহণ করা হয় এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য খুদে বার্তা আসে। আবেদনকারী মো. সেলিম উল্লাহ বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য জমিটি বিক্রি করা জরুরি ছিল, কিন্তু দুই মাসেও নামজারি হয়নি।’

বাগেরহাটে ভূমিসেবা সার্ভারের কাজ না হওয়ার কারণে ১৫০ ধারায় মিউটেশন এবং খতিয়ানে নাম পরিবর্তনসহ হাজারো কেস অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। জমির নামজারি বন্ধ থাকায় খাজনা দেওয়া এবং জমি কেনাবেচা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত ২৮ দিনে বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে কম শতাংশে: ফকিরহাটে ৪৪%, মোরেলগঞ্জে ৬২%, সদরে ৫৮%, মোল্লাহাটে ৬৬%, রামপালে ৬৪%, মোংলায় ৭৫%, চিতলমারীতে ৮৩%, কচুয়ায় ৭৯%, এবং শরণখোলা উপজেলায় ৫৮%।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!