ভরা মৌসুমে ইলিশ আহরণ কমেছে ২৭%

প্রতি বছর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরকে ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ে বছরে মোট আহরিত ইলিশের দুই-তৃতীয়াংশ দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছর ধরে সারা দেশে ইলিশের উৎপাদন কমছে। এ বছর ভরা মৌসুমের দুই মাস—জুলাই ও আগস্টে—বরিশাল বিভাগে গত বছরের তুলনায় ইলিশ আহরণ ২৭ শতাংশ কম হয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জুলাই ও আগস্টে বরিশাল বিভাগে ইলিশ আহরণ হয়েছে ২৯,৫১৯.৪৬ টন। গত বছর একই সময়ে আহরণ হয়েছিল ৪০,২৯১.২৪ টন। অর্থাৎ মৌসুমের প্রথম দুই মাসে এ বছর ইলিশ আহরণ কমেছে ১০,৭৭১.৭৮ টন বা ২৭ শতাংশ। এর ফলে এ বছরের বার্ষিক আহরণও হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছর ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু এ বছর সেই নিষেধাজ্ঞা নেই। তবুও নদী ও সাগরের মিলিত আহরণ গত বছরের তুলনায় অনেক কম হয়েছে।

মৎস্য বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে গত দুই বছর ধরে ইলিশ উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২৩-২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪১,৮৫৫ টন কম ইলিশ আহরণ হয়েছে। চলতি বছরে মোট আহরণ হয়েছে ৫,২৯,৪৮৭ টন, যার মধ্যে নদী থেকে ২,৪৮,৪১৪ টন, সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে ৪৫৫ টন এবং সাগর থেকে ২,৮০,৯১৮ টন ইলিশ ধরা পড়েছে। তুলনায়, ২০২২-২৩ সালে মোট আহরণ হয়েছিল ৫,৭১,৩৪২ টন, যার মধ্যে নদী থেকে ২,৭০,৮৮৫ টন, সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে ৪৪৫ টন এবং সাগর থেকে ৩ লাখ ১২ টন ইলিশ আহরণ হয়েছিল। এছাড়া, ২০২৪-২৫ সালের সার্বিক আহরণের হিসাব এখনো সম্পন্ন হয়নি। তবে গত বছরের ইলিশের আকালকে বিবেচনা করলে, এবারও আহরণ কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এর আগের তিন বছরে ইলিশ আহরণ আগের বছরের তুলনায় সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২১-২২ সালে মোট আহরণ হয়েছিল ৫,৬৬,০০০ টন, ২০২০-২১ সালে ৫,৬৫,০০০ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫,৫০,০০০ টন এবং ২০১৮-১৯ সালে ৫,৩২,০০০ টন। গত অর্থবছরের উৎপাদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ বছর ইলিশ উৎপাদন আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় ইলিশের দাম নাগালের বাইরে। ভরা মৌসুমেও সরবরাহ কম থাকায় বাজারে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। তাছাড়া, ইলিশ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি।

চলতি বছর বাদে বরিশাল বিভাগে গত পাঁচ বছরে ইলিশ উৎপাদনের হিসাবে দেখা যায়, প্রথম চার বছর ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ২০২৩-২৪ বছরে উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ২৩ হাজার ৫০৯ টন কমে যায়। সে বছর উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩৪ টন। তার আগের বছর ২০২২-২৩-এ উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টন। এছাড়া ২০২১-২২ বছরে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ টন, ২০২০-২১ বছরে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩০১ টন ও ২০১৯-২০ বছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৭ টন ইলিশ উৎপাদন হয়।

বরিশালের অন্যতম বড় ইলিশ মোকাম পোর্ট রোডে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশের সরবরাহ কম। আড়তদাররা জানান, এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম পৌঁছেছে ২,৩৫০ টাকা। খুচরায় এই দাম ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশের দাম ৪,০০০ টাকায় পৌঁছাচ্ছে।

বরিশালের হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘বর্ষার এ সময় ইলিশ আহরণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে এবার বৃষ্টি ও জোয়ার থাকলেও ঘাটে ইলিশের সরবরাহ কম। এ সময়ের তুলনায় আগের বছর অনেক বেশি ইলিশ উঠেছিল।’

বরগুনার পাথরঘাটা, পটুয়াখালীর মহিপুর-আলীপুর, ভোলার চরফ্যাশনসহ বরিশাল বিভাগের সব বাজারের চিত্র একই। আড়তে ইলিশ আসছে খুব কম। যেটুকু আসছে তার দাম অস্বাভাবিক বেশি। পাথরঘাটার বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার মাসুদ সিকদার গত মঙ্গলবার জানান, এদিন মাত্র ৫৫৬ কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে। এক কেজি ওজনের একেকটি মাছের দর ছিল ৩ হাজার টাকা।

মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দিন শেখ বলেন, ‘ইলিশ সাধারণত ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীতে আসে। জুলাই থেকে বেশি পরিমাণে ইলিশ নদীতে আসে বলে তখন ভরা মৌসুম ধরা হয়। তবে এবার তুলনামূলক ইলিশ কম ধরা পড়তে পারে। এর সঙ্গে বাজারের চাহিদা, পরিবহন ব্যয় এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিও যুক্ত।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হলেও ইলিশ এখন দেশের সবচেয়ে দামি মাছ। তবু যাদের কঠোর পরিশ্রমে মাছ ধরা হয়, সেই জেলেরা খুব সামান্য টাকা পান। মাঝখানে বড় মুনাফা লুটছে সিন্ডিকেট। এ কারণে ইলিশের জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ এবং নজরদারি বাড়ানোর সময় এসেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!