বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক গত চার বছরে আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছে। অধিকাংশ কর্মকর্তাকে নানা কারণে জোরপূর্বক ছাঁটাই করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে দেড় হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের বেশি সময় একই শাখায় ও বিভাগে বহাল রেখেছে। আবার একই বিভাগে চার থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বহাল রাখারও নজির রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে এমন অনিয়মের ভয়ঙ্কর চিত্র ওঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্র্যাক ব্যাংক ২০২১, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পর্যায়ক্রমে ৭২০ জন, ৯৯৮ জন, ৮৩৫ জন ও ১১৫ জনকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। চার বছরে সব মিলিয়ে দুই হাজার ৬৬৮ জনকে বাদ দেয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকটি বলছে, কাউকে জোরপূর্বক বাদ দেয়া হয়নি। যেসব কর্মকর্তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, তা পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বাদ দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, টানা চার বছর ধরে সর্বোচ্চ পারফর্মার হওয়ার পরও শুধু এক বছর নন-পারফর্মার হিসেবে মূল্যায়ন করে চাকরি হতে অপসারণ করা হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। পারফরম্যান্স মূল্যায়ন ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিভাগ ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, যার কোনোটিই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদিত নয়। এছাড়া ব্যাংকটির সব স্থায়ী কর্মকর্তারা একক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়িত হন না। আবার বিভিন্ন বিভাগের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রধানের পছন্দ বা অপছন্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাছাড়া ব্যাংকটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পাশপাশি বিভাগভিত্তিক আলাদা মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকায় বিভাগ প্রধানের আলাদা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা ব্যাংকটির সার্বিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খল এবং অকার্যকর কলে তুলছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নন-পারফরমার হিসেবে মূল্যায়িতদের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে টার্মিনেট করার হুমকি দেয়া হয়। ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত পরিসংখ্যানও এই অভিযোগ প্রমাণ হয়। টার্মিনেট হলে অন্য কোথাও চাকরি হবে না, এই ভয়ে অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সাল এই তিন বছরে দুই হাজার ৫৫৩ জনকে ব্যাংক চাকরিচ্যুত করে। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখায় ৯৫ শতাংশ। টার্মিনেশন ৩ শতাংশ এবং ডিসমিসাল ২ শতাংশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কোথাও একটি প্রতিষ্ঠানের ৯৫ শতাংশ কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন। ব্যাংকটি অধিকাংশ কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত করেছে। যারা চাকরি ছাড়তে চাননি, তাদের টার্মিনেশনের ভয় দেখানো হয়েছে। অনেকে অন্য কোথাও চাকরি পাবেন না; ভয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাকরিচ্যুত হওয়া কর্মকর্তা এ বি এম সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত প্রতিবেদনে কর্মকর্তা কাশপিয়া আশফাকের স্বাক্ষর রয়েছে। যদিও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাশপিয়ার নিয়োগের কোনো অনুমোদন নেই। কেবল হেড অব ইনভেস্টিগেশন বিভাগের হাফিজুল ইসলাম মৌখিক নির্দেশে তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়োজিত করেন। মাত্র একজন কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, যা কোনো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা স্পষ্ট প্রমাণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা জেসমিনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি উত্তরা শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। জেসমিন বলেন, স্বেচ্ছায় কেউ চাকরি ছাড়ে না। সবাইকে জোরপূর্বক বাদ দেয়া হয়েছে। আর স্বেচ্ছায় কেন চাকরি ছাড়তে যাব। ২০২৩ সালে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার বানানোর কথা ছিল। তা না বানিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন ইকরাম কবির বলেন, গত পাঁচ বছরে সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি চলে গেছেন। এই পাঁচ বছরে ব্র্যাক ব্যাংক সাড়ে চার হাজার ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দুই রকমভাবে ব্র্যাক ব্যাংক ছাঁটাই করেছে।
তিনি আরও বলেন, প্রথমত পারফরম্যান্সের কারণে ২৩৯ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এরা বেশির ভাগই রিটেইল ও এসএমইর। এদের টার্গেট দেয়া হয়। ছয় মাস ধরে দেখা হয়। ছয় মাসে টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ট্রেনিং দেয়া হয়। এরপর টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ছাঁটাই করা হয়।
দ্বিতীয়ত, ২২২ জনকে শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকালাপের জন্য ছাঁটাই করা হয়। এসব বাংলাদেশ ব্যাংককেও আমরা জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে তথ্য দিয়েছে, তার সঙ্গে একমত নই। আমাদের ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া পুরো ডকুমেন্টেড। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে আসলে নতুন কিছু নেই।
অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-১৫ এর নির্দেশনা লংঘন করে ১ হাজার ৫৪৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একই শাখা/বিভাগে বহাল রেখেছে ব্যাংকটি। আবার একই বিভাগে চার থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বহাল রাখারও নজির রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তদন্ত প্রতিনিধি দলকে বলা হয়, ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সব কাজ বিশেষায়িত এবং বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ধারা করা হয়। যদিও নিয়োগের সময় তাদের বিশেষায়িত এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি ব্যাংকটি।