ব্যান্ডউইথ দামের বৈষম্যে বিপাকে ‘আইএসপি’

মোবাইল অপারেটররা (এমএনও) ব্রডব্যান্ড সেবাদাতাদের (আইএসপি) তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে ব্যান্ডউইথ কিনলেও গ্রাহকরা সাশ্রয়ী মোবাইল ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন না। ট্যারিফ সিলিং না থাকায় বিদেশি এমএনওরা সুবিধাভোগী, অথচ দেশীয় আইএসপিরা বৈষম্যের শিকার। এর ফলে ইন্টারনেট সঞ্চালনব্যবস্থায় অসমতা তৈরি হচ্ছে এবং বিটিআরসি রাজস্ব হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যান্ডউইথের মূল্য নির্ধারণে সমতার দাবি তুলেছে আইএসপিরা।

আইআইজি থেকে ব্যান্ডউইথ নিয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের সরবরাহ করে আইএসপি এবং এমএনও প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের মধ্যে আইএসপি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং এমএনওগুলো মোবাইল ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। আইএসপিদের কাছে আইআইজি কী মূল্যে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বিক্রি করবে সে বিষয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ট্যারিফ সিলিং নির্ধারণ করে বিটিআরসি।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি সেকেন্ডে ৫০ থেকে ১ হাজার মেগাবিট (এমবিপিএস) পর্যন্ত ব্যান্ডউইথের জন্য ঢাকার মধ্যে ৩৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৯৯ টাকা রেটে আইএসপিদের বিক্রি করবে আইআইজি। অর্থাৎ ট্যারিফ সিলিং ৩৬৫ থেকে ৩৯৯ টাকা। এভাবেই ১ হাজার ১ এমবিপিএস থেকে ১ লাখ এমবিপিএস পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে এই ট্যারিফ ৩৩০ থেকে ৩৯৫ টাকা। ২০২৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এই ট্যারিফের শর্তানুযায়ী, ব্যান্ডউইথের মূল্য এই ট্যারিফ রেটের মধ্যে রাখতে হবে।

একটি বড়ো আইআইজির হিসাব থেকে দেখা গেছে, ১ হাজার এমবিপিএস নেওয়া একাধিক আইএসপির কাছে ৩৬৫ টাকা রেটে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করা হয়েছে। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর গ্রামীণফোনের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করা হয়েছে ২১৮ টাকা রেটে।

আইএসপিএবির সভাপতি ইমদাদুল হক জানান, এমএনওদের কাছে আইআইজির ব্যান্ডউইথ বিক্রির গড় মূল্য ১৮০ টাকা। অর্থাৎ আইএসপির তুলনায় প্রায় অর্ধেক মূল্যে ব্যান্ডউইথ কিনছে কনে মোবাইল অপারেটরগুলো।

বিদেশি মোবাইল অপারেটরগুলো কম দামে ব্যান্ডউইথ পাওয়ায় দেশি আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন বলে দাবি করেন টেলিকম বিশেষজ্ঞ কামাল হোসেন। তিনি বলেন, আইএসপি যেমন আইআইজিদের গ্রাহক তেমনি এমএনও প্রতিষ্ঠানগুলোও গ্রাহক।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশি আইএসপিদের কাছে রেট বেশি কিন্তু বিদেশি এমএনওদের জন্য রেট কম; এমনকি এমএনওদের জন্য কোনো ট্যারিফ সিলিংই নেই। কোন যুক্তিতে এটাকে ‘এলাউ’ করা হচ্ছে? আবার আইএসপির তুলনায় কম দামে ব্যান্ডউইথ পেয়েও ব্রডব্যান্ডের তুলনায় স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট কিন্তু দিচ্ছে না এমএনওগুলো। মোবাইল ইন্টারনেটের দাম ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের তুলনায় বেশি। তাহলে এ ব্যবস্থায় উপকৃত হচ্ছেন কারা? গ্রাহক তো উপকৃত হচ্ছে না।

আইএসপি ও এমএনওদের ট্যারিফ পার্থক্যের ফলে ইন্টারনেট সঞ্চালন খাতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক। তিনি বলেন, এমএনওদের জন্য নির্ধারিত ট্যারিফ না থাকায় ব্যবসার সুস্থ প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং বিটিআরসি রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আইআইজি থেকে কেনা ব্যান্ডউইথের রেভিনিউ শেয়ার আইএসপিদের ক্ষেত্রে ৩৬৫ টাকা, কিন্তু এমএনওদের ক্ষেত্রে মাত্র ১৮০ টাকা। সমতা আনতে ব্যান্ডউইথের মূল্য সবার জন্য ৩৬৫ টাকায় উন্নীত করা, ১৮০ টাকায় নামিয়ে আনা বা ট্যারিফ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।

তিনি বলেন,প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সবাই অন্যদের সঙ্গে ‘ফাইট’ করে নিজ মূল্যে গ্রাহককে আকৃষ্ট করবে। আমি চাই, মূল্য ১৮০ টাকায় নামিয়ে আনা হোক। তাহলে ইন্টারনেটের মূল্য আরও কমে আসবে, যার সুফল পাবে সাধারণ ব্যবহারকারীরা।

মোবাইল অপারেটররা কম দামে ব্যান্ডউইথ কিনলেও অধিকাংশ ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করে আইএসপিরা বলে উল্লেখ করেন আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক। বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী, ১ কোটি ৩০ লাখ ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর মধ্যে ৫৫% ইন্টারনেট সরবরাহ করে আইএসপিরা, আর প্রায় ১২ কোটি মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ৪৫% ইন্টারনেট সরবরাহ করে এমএনওরা। দামে সুবিধা পেলেও এমএনওরা অধিকাংশ গ্রাহককে সেবা দিতে পারছে না। তিনি বলেন, যদি বাজারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকত, তাহলে আরও বেশি মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা পেত।

মোবাইল অপারেটররা ব্যান্ডউইথের মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ চায় না বলে জানিয়েছেন রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম। তিনি বলেন, মোবাইল অপারেটর ও আইআইজি পর্যায়ে ব্যান্ডউইথের মূল্য ভলিউম, মান ও দক্ষতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, যা একটি বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) প্রক্রিয়া। উৎপাদন ব্যয় মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে।

পাশাপাশি উন্মুক্ত বাজারব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করে নরওয়েভিত্তিক টেলিনরের মালিকানাধীন গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ বলেন, বিটিআরসির যে নির্দেশিকা তা নির্দিষ্ট মাত্রার ব্যান্ডউইথ ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে মোবাইল অপারেটররা একসঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যান্ডউইথ ক্রয় করে থাকে।

বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে বাল্ক পরিমাণে কেনাকাটায় মূল্য ছাড় স্বাভাবিক বিষয় উল্লেখ করে মোবাইল অপারেটররা বলছে, বড় পরিমাণে ব্যান্ডউইথ কেনায় তারা ডিসকাউন্ট সুবিধা পায়। তারা মনে করে, উন্মুক্ত বাজারে এই সুবিধা সবার জন্য থাকা উচিত, যাতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যান্ডউইথ কিনতে পারে। এতে সম্পদের দক্ষ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বাংলালিংক, যা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক মালিকানাধীন, এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। অন্যদিকে, টেলিকম খাতে অনেক বিষয়েই ট্যারিফ ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মূল্য বাজারের নিজস্বভাবে নির্ধারণ করা উচিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হয়, নতুবা ‘ম্যাল-প্র্যাকটিস’ হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিটিআরসি ট্যারিফ নির্ধারণের পক্ষে নয়।

আইএসপি পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম ২০ শতাংশ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সরকারের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে। গতকাল (রোববার) এ বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত আসলে ইন্টারনেটের দাম আরও কমে আসবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!