ব্যাগেজ রুলে স্বর্ণ এসেছে ১০৪ টন, ৯০% পাচার

দেশে গত চার অর্থবছরে (২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪) বিদেশ থেকে লাগেজে করে স্বর্ণ এসেছে ১০৪ টনেরও বেশি। ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বৈধভাবে শুল্ক-কর পরিশোধ করে আনা এ স্বর্ণ পরিমাণে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণ রিজার্ভের (১৪ টন) সাত গুণেরও বেশি। বিপুল পরিমাণে আনা এ স্বর্ণের অন্তত ৯০ শতাংশ প্রতিবেশি দেশ ভারতে পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা স্বর্ণের খুব কমই গৃহস্থালি খাত বা অলংকার শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। বেশির ভাগই নানা হাত ঘুরে পাচার হয়ে যাচ্ছে সীমান্তে। ব্যাগেজ রুলসের সহজ নীতিমালা ও শুল্ক-কর পরিশোধের পর এগুলোর পরবর্তী গন্তব্য চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ না থাকায় এসব স্বর্ণ খুব সহজেই পাচার হয়ে যাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, পাচারকারীদের মধ্যে এখন এমন এক চক্র দাঁড়িয়েছে, যার সদস্যদের কাজ হলো শুধু ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনা-নেয়া করা। কখনো কখনো তারা প্রবাসীদেরও এ কাজে ব্যবহার করছে। বিমানবন্দরে খালাস হওয়া এসব স্বর্ণ নানা হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে।

ঢাকা কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে বৈধপথে স্বর্ণ এসেছে ১০৪ টন। এর মধ্যে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এসেছে ১৭ হাজার ৮৯৪ কেজি ৩৭৫ গ্রাম (১৭ দশমিক ৮৯ টন)। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ৪৩ হাজার ২০ কেজি (৪৩ দশমিক শূন্য ২ টন)। আর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৩৪৬ কেজি (১১ দশমিক ৩৪ টন) ও ৩১ হাজার ৭৭৮ কেজি (৩১ দশমিক ৭৭ টন)। সব মিলিয়ে এ সময় মোট স্বর্ণ এসেছে ১০৪ টনেরও বেশি। বিদেশ থেকে আনা এ স্বর্ণের পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ রিজার্ভের সাত গুণেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট স্বর্ণ রিজার্ভের পরিমাণ ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৬৮ দশমিক ৬১ ট্রয় আউন্স বা ১৪ টনের কিছু বেশি।

CIID Gold
ব্যাগেজ রুলস বিধিমালা অনুযায়ী, শুল্ক-কর পরিশোধ করে বিদেশ থেকে একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের স্বর্ণ আনতে পারবেন। এ ১০৪ টন স্বর্ণের পুরোটাই এ ব্যাগেজ রুলস বিধির আওতায় বৈধভাবে আনা। সে অনুযায়ী, গত চার বছরে বিদেশ থেকে এভাবে বৈধপথে আনা স্বর্ণের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৮ লাখ ৯০ হাজারটির কাছাকাছি। বিধিমালায় ১১৭ গ্রামের অতিরিক্ত স্বর্ণ আনলে সেটিও নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা পরিশোধ করে ছাড়িয়ে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ অতিরিক্ত স্বর্ণ কাস্টমসের তালিকাভুক্ত হয় ‘ডিএমকৃত’ হিসেবে।

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিএমকৃত স্বর্ণালংকার খালাস করা হয়েছে ৪১৭ কেজি ৪৩৫ গ্রাম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫৫৪ কেজি ৬৪৩ গ্রাম। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫০৭ কেজি ৮৩৮ গ্রাম ও ৬৯৭ কেজি ৬৬৯ গ্রাম। এসবের বাইরেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বৈধপথে স্বর্ণ এসেছে ১ হাজার ২৬০ কেজি ৯৫০ গ্রাম। এছাড়া ডিএমকৃত স্বর্ণ এসেছে ৫৫ কেজি ৬৯৪ গ্রাম।

দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ব্যাগেজ রুলস সুবিধায় ২৬ ধরনের পণ্য আনার ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা কেবল বাহকের ভূমিকা পালন করেন। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই তারা লাগেজ ভর্তি পণ্য তুলে দেন চোরাকারবারিদের হাতে। এতেই প্রতি বছর দেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। ধ্বংস হচ্ছে স্থানীয় স্বর্ণশিল্প।

সর্বশেষ গত ৩ জুন সোনা ও হীরা চোরাচালানে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাজুস বলেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত অবস্থিত। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। সোনার বড় একটি অংশ এসব জেলার সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি টাকার সোনা ও সোনার অলংকার এবং ৩০ কোটি টাকার হীরা ও হীরার অলংকার বাংলাদেশে আসছে। সে হিসাবে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে ৮০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সোনা ও ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার হীরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। এ পুরো টাকাটাই হুন্ডির মাধ্যমে সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে। ফলে সরকার রেমিট্যান্স হারাচ্ছে এবং সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে যাচ্ছে।

বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় যেসব স্বর্ণের বার দেশে আসছে, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার কোথায় হচ্ছে তা অজানা। স্বর্ণের বার যেগুলো আসে, সেগুলো যদি দেশের গহনা শিল্পের চাহিদা পূরণে যোগ করা যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে উৎসাহ দেবেন। এক্ষেত্রে ব্যাগেজ রুলসের সঠিক প্রয়োগ বা একে পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশ থেকে স্বর্ণ পাচার রোধ করার ব্যবস্থা নেয়া গেলে তা দেশকে সমৃদ্ধ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজে আসবে।
Gold 01

জানা গেছে, বৈধ পথে আনা স্বর্ণগুলো প্রধানত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ বৈধ-অবৈধভাবে দেশে আসে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে এসব স্বর্ণ পাচারের বড় একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে রিয়াজউদ্দিন বাজার। রিয়াজউদ্দিন বাজারে কোনো স্বর্ণের দোকান না থাকার পরও বড় কয়েকটি সিন্ডিকেট এ এলাকাকে কেন্দ্র করেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেইন এলাকায় আছে অনেকগুলো বিপণিবিতান। এসব বিপণিবিতানের ওপরের ফ্লোরগুলোকে গুদামঘর বা অন্য কাজের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। এর বেশ কয়েকটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট অবৈধ স্বর্ণের গুদাম বানিয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে আনা স্বর্ণ হাতবদলের মাধ্যমে এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বর্ণের বাহকদের বিমান ভাড়ার একাংশও বহন করে এ সিন্ডিকেট। এসব স্বর্ণ ঢাকাসহ বিভিন্ন রুট হয়ে নেয়া হয় কুমিল্লা জেলা ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলার সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে তা পাচার হয়ে যায় ভারতে। পাচারের সময় এর একাংশ ধরাও পড়ছে। খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গায় চলতি পঞ্জিকাবর্ষে এ পর্যন্ত ভারতে পাচার হওয়ার সময় ৪১ কেজি ৫৭২ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী, যার আনুমানিক মূল্য ৪০ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন উদ্ধার করেছে সাড়ে আট কেজির বেশি। বাকিটুকু আটক করেছে ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়ন।

চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ৮ কেজি ৫৭২ দশমিক ৬৩ গ্রাম ওজনের অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধার করেছে। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের মূল্য ৯ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৫৩৫ টাকা। ব্যাটালিয়নটির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান পিএসসি বলেন, কম খাটুনিতে বেশি রোজগারের আশায় এখানে অনেকেই অবৈধ স্বর্ণ পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। সীমান্তে বিজিবি কঠোর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। পাচারকারীদের কোনো অবস্থায়ই ছাড় দেয়া হবে না। ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুস শহীদ জানান, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত সীমান্তে পাচার হওয়ার সময় ৩৩ কেজির মতো স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়, যার মূল্য ৩১ কোটি টাকার বেশি। এ সময় আটক পাচারকারী নয়জনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়েছে। ব্যাটালিয়নটি চলতি বছর ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকেও পাচারকালে বড় দুটি স্বর্ণের চালান উদ্ধার করেছে। আজিজুস শহীদ জানান, মহেশপুর সীমান্ত থেকে চলতি বছর বড় দুটি স্বর্ণের চালান আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জানুয়ারি ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার ও ১৮ নভেম্বর ৫ কেজি ৪৭৮ গ্রাম ওজনের ৪৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

সূত্রের ভাষ্যমতে, গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন ও এর পরবর্তী অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ ইস্যুতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বড় একটি অংশকে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে সীমান্তে পাচারকালে এবার স্বর্ণ ধরা পড়েছে কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্বর্ণ চোরাচালানের বড় হটস্পট হয়ে ওঠা যশোর সীমান্তে এ বছর মাত্র ৭ কেজি স্বর্ণ আটক হয়েছে বলে স্থানীয় বিজিবি সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে এখন স্বর্ণ চোরাচালানের ৬৩১টি মামলা নিয়ে তদন্ত চলছে। স্বর্ণ পাচারের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ২১টি মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। তবে বছরের পর বছর পার হলেও এসব মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, যেকোনো ধরনের চোরাচালানই দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশ পুলিশ স্বর্ণসহ সব ধরনের চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!