সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর তিনটি লকার খুলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরও শতাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার লকারের সন্ধান পায়। দুদকের ধারণা, এসব লকারে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ-সম্পদ থাকতে পারে। এক কর্মকর্তা জানান, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, দেশের প্রতিটি ব্যাংক শাখায় লকার সার্ভিস রয়েছে, যেখানে জমা থাকা সম্পদের তথ্য কেউ জানে না। এতে লকার ব্যবস্থাকে বিকল্প সুইস ব্যাংক বলেই মনে করা হচ্ছে।
দুদক সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সবারই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লকার রয়েছে। যেখানে তারা জমা করেছেন অপ্রদর্শিত আয়। এসব সম্পদ আয়কর রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কী না তা কখনোই কেউ খতিয়ে দেখেননি। তবে এসকে সুর চৌধুরীর পর এবার আরও অনেকের লকার খোলার অপেক্ষায় আছে দুদক। আদালতও এরই মধ্যে খোলার অনুমতি দিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, শুধু ব্যাংকের কর্মকর্তারাই নন। দুদক এখন দেশজুড়ে থাকা সব ব্যাংকের লকারগুলোকেই সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। গ্রাহকেরা কে কি রাখছেন তা কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অজানা থাকবে সে বিষয়টিই প্রশ্নের। দুদক বলছে, বিগত ১৬ বছরে অনেক প্রভাবশালী নেতা, সরকারি কর্মকতা আয়-বহির্র্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। যা সংস্থাটির অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত একশ’র বেশিসংখ্যক মামলাও করেছে দুদক। তবে আড়ালেই রয়ে গেছে তাদের লকার। যেখানে থাকতে পারে সেসব নেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রদর্শিত আয়ে গড়া অর্থ সম্পদ।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও দলটির এমপি-মন্ত্রীরা অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি হয়েছেন। কিন্তু এসকে সুর চৌধুরীর লকার খোলার পর ধারণা করা হচ্ছে- এমন বহু লকার আছে। যা দুদকের মামলার তথ্য থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এসব লকার খুললে বোঝা যাবে কার কী পরিমাণ গোপন অর্থ-সম্পদ রয়েছে। এ ধরনের একটি অনুসন্ধান দুদকের পক্ষ থেকে করার বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
দুদক জানায়, ২রা ফেব্রুয়ারি আদালতে আবেদন করে এসকে সুর চৌধুরীর লকার খুলে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় এবার বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসসহ আরও অনেক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ডিপোজিট খোলার অনুমোদনের জন্য আদালতে চিঠি দিয়েছে দুদক। এছাড়া, ব্যাংকের লকারে থাকা অন্যান্য গ্রাহকদের গোপন অর্থ-সম্পদের তথ্যও উন্মোচিত হতে পারে।
দুদকের পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৬শে জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েন ভল্টে সাবেক ডেপুটি গভর্নরের সেফ ডিপোজিট তল্লাশির সময় দেখা যায়, অন্যান্য কিছু কর্মকর্তাও সিলগালা করা সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এতে অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, এসব লকার তল্লাশি ও ইনভেন্টরি লিস্ট তৈরির অনুমতি চেয়ে দুদক আদালতে আবেদন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার নিরাপত্তা ভল্টে থাকা লকারগুলো খোলার অনুমতি পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, একইদিন চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন লকার না খুলতে পারেন বা লকার থেকে কোনো কিছু না তুলতে পারেন সেজন্য অবরুদ্ধ করার চিঠি দিয়েছে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের স্বাক্ষর করা ওই চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরারব পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- ইতিমধ্যেই সেই চিঠি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লকার খোলার বিষয়ে আদালতের অনুমতি পেয়েছি। এছাড়া সবার লকার ফ্রিজ করার জন্য কমিশন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ চলমান।
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ নুরুল আমীন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের লকার সাধারণত মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র ও অলঙ্কার সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এখন সেখানে বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কারও রাখা হচ্ছে, যা নির্দিষ্ট জামানত ও বার্ষিক ফি দিয়ে পরিচালিত হয়। লকারের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ গ্রাহকের, ব্যাংকের নয়। বৈধ সম্পদ রাখা গেলেও অবৈধ সম্পদ সংরক্ষণ দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদালতের অনুমতি নিয়ে লকার খুলতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে লকার ভাড়া ছোট লকারের জন্য ২ হাজার, মাঝারি লকারের জন্য সাড়ে ৩ হাজার এবং বড় লকারের জন্য সাড়ে ৪ হাজার টাকা। জামানত হিসেবে রাখা হয় ৫ হাজার টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে লকার ভাড়া সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকরা লকারে কী রাখছেন—তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জানার বা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। নির্ধারিত চার্জের বিনিময়ে লকারের চাবি গ্রাহককে দেওয়া হয়, এরপর সেখানে তিনি কী সংরক্ষণ করছেন, তা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত বিষয়।
ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, সেফ ডিপোজিট লকার দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। সেসব নিয়ম পালন করলেই একজন গ্রাহক লকার পাবেন। তবে গ্রাহক তার লকারে কী রাখছেন দেখার সুযোগ আমাদের নেই। লকার দেয়ার সময় তাকে চাবি দিয়ে দেয়া হয়। আবার ভাঙার সময় তিনিই চাবি খোলেন। তবে সে সময় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন।
দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার লকারে অর্থ-সম্পদ থাকতে পারে। তবে লকারগুলো খোলার পরই প্রকৃত হিসাব মিলবে। দুদকের টিম বিষয়টি তদন্ত করছে এবং পাওয়া তথ্যগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্তমান কমিশন অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ উদ্ধারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে, এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে।