ব্যর্থ ব্যাংক অবসায়নে ‘ব্রিজ ব্যাংক’

ব্যর্থ ব্যাংক অবসায়নে সহজ পন্থা হিসেবে সরকার প্রথমবারের মতো ব্রিজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। নতুন আইন অনুযায়ী ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ নামের এই প্রতিষ্ঠান চালু হবে। ব্যাংক রেগুলেশন অর্ডিন্যান্সের চূড়ান্ত খসড়ায় এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ব্যাংক মার্জ করার জটিলতায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছিল না, তখন ব্রিজ ব্যাংক দুর্বল ও ব্যর্থ ব্যাংক অবসায়নে কার্যকর সমাধান হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

খসড়া আইনে ব্রিজ ব্যাংকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান, যা রেগুলেশনের অধীনে তফসিলি (ব্যর্থ) ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এবং কার্যকর পরিচালনা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখবে। শেষে, এটি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে গঠিত হবে। যতদিন না ক্রেতা পাওয়া যায়, ততদিন এই ব্রিজ ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করবে। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বা একাধিক ব্রিজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা পাবে।

এই ব্রিজ ব্যাংকগুলো ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অস্থিতিশীলতা মোকাবেলার সময় প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং পরিষেবা নিশ্চিত করবে।দেশে চতুর্মুখী সংকটে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিগ্রহণ, দুর্বল ব্যাংক অবসায়নের জন্য নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। এই আইন করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

জানা যায়, মূলধন বা তারল্য, দেউলিয়াত্ব বা ব্যাংকের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ অন্য যেকোনো ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান করতে হবে।পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তফসিলি ব্যাংকের রেগুলেশন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দিতে নতুন আইন করা হচ্ছে। এই আইনের নাম দেওয়া হবে ব্যাংক রেগুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫। এই অধ্যাদেশ অন্য আইনের চেয়ে প্রাধান্য পাবে। এরই মধ্যে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে গত রবিবার মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

খসড়া আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তফসিলি ব্যাংকের পরিশোধ, নিকাশ, নিষ্পত্তিব্যবস্থা চলমান রাখাসহ আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষা করা; গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ব্যাংকের সুরক্ষিত আমানত রক্ষা করা।এ ছাড়া ব্যাংকের সম্পদের মূল্য হ্রাস এড়ানো এবং পাওনাদারদের লোকসান ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা ও সামগ্রিক ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হবে। আর্থিক ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বজায় রাখতে কাজ করবে।

খসড়া আইনের নীতিতে বলা হয়, তফসিলি ব্যাংকের অবসায়ন প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হলে শেয়ার ধারক এবং ব্যাংকের পাওনাদারদের যে ক্ষতির সম্মুখীন হতো তা অপেক্ষা অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। আমানতকারীদের সুরক্ষিত পরিমাণের স্তর পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত থাকবে। তফসিলি ব্যাংকগুলো যেন সুশৃঙ্খলভাবে বাজার থেকে প্রস্থান করতে পারে রেগুলেশন প্রক্রিয়া তা নিশ্চিত করবে।

খসড়া আইন বলা হয়, তফসিলি ব্যাংক কার্যকর নয়, কিংবা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী রেগুলেশন করার সিদ্ধান্ত নেবে। কিংবা দেউলিয়া হয়েছে বা দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমনকি তফসিলি ব্যাংক আমানতকারীদের বা অন্য পাওনাদারদের দায়বদ্ধতা পূরণে অক্ষম হয় তাহলে এটি করা হবে। ব্যাংকের প্রকৃত সুবিধাভোগী মালিক বা দায়ী ব্যক্তিরা ব্যাংকটির সম্পদ বা তহবিলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেদের বা অন্যের স্বার্থে প্রতারণামূলকভাবে ব্যবহার করাসহ ব্যাংক এমন বিপজ্জনক বা ত্রুটিপূর্ণ চর্চায় জড়িত হওয়া ব্যাংকের দুর্বল হলে বা সুষ্ঠু কার্যক্রম ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং এর ফলে ক্ষতি হবে এমন হলেও ব্যাংক রেগুলেশন করা হবে।

আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকবে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর পরিচালনায় অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা। দুর্বল ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা অর্জন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রশাসকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করবেন। রেগুলেশন ব্যবস্থা চালু হলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের ব্যবসা পরিচালিত হবে এবং এর জন্য একজন অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। সেই সময়ে ব্যাংকের শেয়ার, সম্পদ এবং দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তফসিলি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এবং কার্যকর পরিচালনা অব্যাহত রাখতে এক বা একাধিক ব্রিজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা পরবর্তীতে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা হবে। ব্যাংকের মূলধন এবং যোগ্য দায় হ্রাস বা রূপান্তর করা হবে। ব্রিজ ব্যাংকের অর্থায়নে অবদান রাখতে ব্যাংক পুনর্গঠন ও রেগুলেশন তহবিল বা আমানত সুরক্ষা তহবিলের শর্তাবলি মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া, তফসিলি ব্যাংকের সম্পদ এবং দায়ের বিশদ পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক উপায় নির্ধারণ করবে। একই সঙ্গে, ব্যাংকের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, মুখ্য ব্যবস্থাপনা কর্মী বা অন্যান্য কর্মীদের অপসারণ বা স্থলাভিষিক্ত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খসড়া আইনে তহবিলের বিষয়ে বলা হয়, ব্যাংক রেগুলেশন ব্যবস্থা কার্যকর বাস্তবায়নে ব্যাংক পুনর্গঠন ও রেগুলেশন তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই তহবিলের বিচক্ষণ ও নিরাপদ বিনিয়োগ কৌশল থাকবে। তহবিলে রক্ষিত অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হবে। ব্যাংক পুনর্গঠন ও রেগুলেশন তহবিলের উৎসগুলোর মধ্যে সরকারের বরাদ্দ করা বাজেট, সরকারের দেওয়া অনুদান, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন অংশীদারদের দেওয়া অনুদান থাকবে। এ ছাড়া তহবিলের বিনিয়োগ হতে পাওয়া আয় ও মুনাফা থাকবে।

এই খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সম্পদ, দায় বা শেয়ারের মূল্য নির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা অনুযায়ী উদ্যোগ নেবে। রেগুলেশনের অধীনে ব্যাংকের শেয়ার বা সম্পদ ও দায় এর সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তান্তরের ওপর নির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করতে পারবে। স্থানীয় ও বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর গ্রহীতা হিসবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। রেগুলেশনের অধীন তফসিলি ব্যাংকের শেয়ারধারকরা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি, বন্ধকীকরণ বা ট্রাস্টে স্থানান্তরসহ অন্য উপায়ে হাস্তান্তর নিষিদ্ধ হবে। তারা এই বিধানের পরিপন্থী লেনদের করলে তা অবৈধ বা বাতিল বলে গণ্য হবে।

রেগুলেশনের অধীন তফসিলি ব্যাংকের হস্তান্তর মূল্য একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। ব্যাংকের হস্তান্তরযোগ্য সম্পদ ও দায় নির্বাচন করার জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ ও দায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ যেমন—ঋণ, নগদ উদ্বৃত্ত, রিজার্ভ তহবিল, বিনিয়োগ ও আমানত।

এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ব্যাংকের জটিলতা সমাধানে এরই মধ্যে নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এরই মধ্যে এটি পর্যালোচনা করেছে। ‘ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট’ নামের নতুন আইনে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, যা প্রয়োগ করে তারা দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্বে অধিগ্রহণ, দুর্বল ব্যাংক অবসান করতে পারবে।

২০২১ সালে দুর্বল ব্যাংক অবসায়নের জন্য ব্যাংক কম্পানি আইনের সংশোধন করা হয়। তখন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নতুন ধারা যুক্ত করে সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু এর পরও কোনো সমাধান সম্ভব হয়নি। দেশে এখন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে যেমন কোনো গবেষণা হয়নি, তেমনি কোনো ব্যাংক অবসায়নের ঘটনাও ঘটেনি।

খসড়া আইনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে সংকট ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল নামের একটি আন্ত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা স্থাপন করা হবে। এই কাউন্সিলের ম্যান্ডেট থাকবে ব্যাংকিং খাতের সংকট কার্যকরভাবে মোকাবেলা এবং হ্রাস করতে সমন্বয় করার পাশাপাশি সহায়তা দেওয়া, যাতে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চেয়ারপারসন করে ছয় সদস্যের কাউন্সিল গঠন করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন বলেন, ব্যাংকের অর্থ আগে যেভাবে তছরুপ হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্গঠন প্রয়োজন। এর জন্য মধ্যবর্তী কোনো পদক্ষেপ হিসেবে ব্রিজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হলে এটি ভালো উদ্যোগ। সরকার ব্যাংক পুনর্গঠনে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে গঠন করেছে। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে বেশ চেষ্টা চলছে। এতে ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের কিছুটা হলেও আস্থা বাড়বে।

**‘ব্রিজ ব্যাংক’ সমাধানে দুর্বল ব্যাংক অবসায়ন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!