ব্যবসায়ী ছদ্মবেশী প্রতারক, ২৬ কোটি হাতিয়ে উধাও

নাম মোতাল্লেছ হোসেন, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পরিচয় নানা রূপে দেন—কখনো বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, কখনো শীর্ষ রাজনৈতিক লিয়াজোঁ অফিসার। তবে বাস্তবে তার পেশা প্রতারণা। সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অনুসন্ধানে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

মোতাল্লেছ হোসেনের প্রতারণার ফাঁদে পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও জড়িত হয়েছেন। যদিও চাকরি রক্ষার স্বার্থে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন, তবু মোতাল্লেছের ব্যাংক হিসাবে নমিনি হওয়ার কারণে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। বিএফআইইউ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোতাল্লেছ ও তার ভাই সম্মিলিতভাবে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা চালিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং ব্যাংক লেনদেনের কিছু অংশের সুবিধাভোগী হতে পারেন ওই কর্মকর্তা।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মোতাল্লেছ হোসেন গত বছরের ৫ নভেম্বর সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলেন। তিন মাসে এই হিসাবটিতে ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হয়, যার মধ্যে ১২ লাখ টাকা এফডিআর করা হয়। পাশাপাশি প্রিমিয়ার ব্যাংকের যশোর শাখায় মানহা জেম ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং এমএল ট্রেডিংয়ের নামে পল্লবীর শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমএল ট্রেডিং ও মানহা জেম ইন্টারন্যাশনালে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও পাওয়া গেছে। এত বিপুল লেনদেন করলেও তিনি আয়কর নথিতে কিছুই দেখাননি; সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে মোট আয় দেখানো হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং নিট সম্পদ ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোতাল্লেছের ভাই মোদাচ্ছের হোসেনের মালিকানাধীন এমএল এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব ২০১৪ সালে খোলা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০ বছরে এখানে ৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হয়েছে, কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা এবং সমপরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জাল ঠিকানা ব্যবহার করে মোতাল্লেছ তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমএল ট্রেডিংয়ের ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। ওই ঠিকানায় (১১/এ, মেইন রোড-৩, প্লট-১০, মিরপুর) এই নামের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে কাচ দিয়ে ঘেরা সেমিপাকা দোকান বানানো হয়েছে। ওই দোকানগুলোতে বেবি শপ, বেসরকারি ব্যাংকের বুথ ও মোটরসাইকেল বিক্রির শোরুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

মোতাল্লেছ হোসেন পল্লবী, মিরপুরের ৯/৫, ৬ষ্ঠ তলায় একাই ভাড়া থাকতেন। গত দুই মাস আগে রাতের আঁধারে তিনি মালপত্র রেখে বাসা থেকে পালিয়ে যান। ওই বিল্ডিংয়ের ৫ তলার ভাড়াটিয়া ফারুক জানান, মোতাল্লেছ একজন প্রতারক ও ভণ্ড প্রকৃতির মানুষ এবং নিয়মিত হ্যারিয়ার গাড়িতে চলাফেরা করতেন। দুই মাস আগে ডিবির লোকজন তার খোঁজে বাসায় গেলে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। পরে ডিবির এক অফিসারের হোয়াটসঅ্যাপ কলের জবাবে মোতাল্লেছ জানান, তিনি বর্তমানে থাইল্যান্ডে রয়েছেন।

অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে মোতাল্লেছ হোসেন বলেন, এ ঘটনায় সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্ত সংস্থাটি ১৫-২০ দিন আগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তা প্রতিহিংসাবশত এই কাজটি করেছে। বিএফআইইউর প্রতিবেদনটি ভুয়া। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক-এই প্রশ্নের জবাবে মোতাল্লেছ বলেন, উনি আমার ক্রেডিট কার্ডের নমিনি ছিলেন। তাও ক্রেডিট কার্ডটা এফডিআরের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বড় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে মোতাল্লেছ হোসেনের বড় ভাই মোদাচ্ছের হোসেনের মন্তব্যে। তিনি দাবি করেছেন, মূলত প্রতিহিংসার কারণে মোতাল্লেছের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়িয়ে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সিআইডি যে মোতাল্লেছের অপকর্ম খুঁজছে, তিনি বলেন, তা এই মোতাল্লেছ নয়; নামের মিল থাকায় তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, মোতাল্লেছ নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ায় এটি তার অপরাধ হতে পারে, তবে চাঁদাবাজি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়। মোতাল্লেছের অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, তা ব্যবসায়িক কাজে করা হয়েছে।

অপরদিকে সন্দেহের তালিকায় থাকা পুলিশের ওই অতিরিক্ত ডিআইজি জানান, তারা দুই ভাই আমার আত্মীয় নয়। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ, আর আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। মোতাল্লেছের ব্যাংক হিসাবের নমিনি আমি কীভাবে হলাম, তা আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, অফিসিয়াল কাজের সূত্রে মোতাল্লেছ দুই-একবার তার অফিসে এসেছিল, তবে তার সঙ্গে এর বাইরে কোনো সম্পর্ক বা জানাশোনা নেই।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!