ব্যবসায়ী নেতারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের কাছে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর কর্মকর্তাদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত, অভিযান ও অতিরিক্ত জরিমানা ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা। এছাড়া এনবিআরের বিভিন্ন আইনি বিধানের কারণেও কীভাবে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা-ও তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে ‘মিট দ্য বিজনেসেস’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এসব উদ্বেগের কথা উঠে আসে।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রায়ই খেয়ালখুশিমতো ভ্যালুয়েশন করে আমদানিকৃত পণ্যের ঘোষিত মূল্য বাড়িয়ে দেন, যার ফলে আমদানিকারকদের অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হয়। তারা বলেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নথিপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করার ঘটনায় ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা আরও বলেন, আমদানি-রপ্তানিতে হারমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোড নিয়ে জটিলতা, অতিরিক্ত জরিমানা ও চড়া ন্যূনতম করের কারণে কার্যকর করহার বেড়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী এনবিআরের কাছ থেকে ভ্যাট রিফান্ডের অর্থ ফেরত পেতে গিয়ে বিলম্বে পান অথবা পান না বলেও উল্লেখ করেন তারা। তবে এসব উদ্বেগের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীরা সাম্প্রতিক কিছু ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপের জন্য এনবিআরকে ধন্যবাদও জানান।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এসব সমস্যা স্বীকার করে হয়রানি রোধে ব্যবসায়ীদের এনবিআরের অটোমেশন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বন্ড লাইসেন্স নেই, এমন ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি সহজ করা হবে। একইসঙ্গে ভ্যাট হার কমিয়ে হলেও স্ট্যান্ডার্ড বা সিঙ্গেল ভ্যাট হার প্রবর্তন করার উপর জোর দেন তিনি। একই সঙ্গে আগামীতে কর অব্যাহতি আরও কমিয়ে আনা হবে বলেও সাফ জানিয়ে দেন এনবিআর চেয়ারম্যান। ‘কর অব্যাহতি আর বহন করা সম্ভব নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩.৭৭ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা স্বত্বেও জিডিপিতে রাজস্বের অবদান বা কর-জিডিপি অনুপাত কমে গেছে।’
সভায় বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান অভিযোগ করেন, অভিযানগুলোতে বেছে বেছে রেস্তোরাঁগুলোকে টার্গেট করা হয়। ইমরান এনবিআর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৮২ হাজার, কিন্তু যত চাপ আসে মাত্র ১৩ হাজারের ওপর। সব অভিযান আমাদের ওপর চালানো হয়। আপনাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অত্যাচারে টিকতে পারছি না। আপনার লোকজন আর আমাদের কিছু লোক মিলে চাঁদাবাজি করে। আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই ভ্যাটের রেট ঠিক করা হয়। এত বেশি ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন, বলেন তিনি। ইমরান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘কিছু দোকানে সফটওয়্যার (ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস—ইএফডি) দিচ্ছেন, কিছু দোকানে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আবার রাস্তায় নামব।’
লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি নাসির খান বলেন, এনবিআর কর্মকর্তাদের দায়ের করা অনেক মাম্লাই পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়। এসব ভুয়া মামলার সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা যুক্ত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে প্রচলিত আইনে ভুয়া মামলা করলে বাদীর শাস্তির বিধান রয়েছে। এনবিআরের যেসব কর্মকর্তা এ ধরণের ভুয়া মামলা করবেন, তাদের বিরুদ্ধেও একই আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকা উচিত।’
আবদুর রহমান খান বেশ কিছু অভিযোগ স্বীকার করে নিলেও সতর্ক করে বলেন, কিছু ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘যখন কেউ ঠিকমতো হিসাবপত্র দেবেন না, তখন তো এই ডিস্টার্ব (জব্দ করা) হবে। আপনি যদি ঠিক থাকেন, তাহলে কম্পিউচার কেন, আপনাকে উঠিয়ে নিলেও সমস্যা নেই। ‘কর্মকর্তাদের কোনো অনিয়ম থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া এনবিআরের নতুন করে চালু হওয়া বিভিন্ন অটোমেশন কার্যক্রম, যেমন ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো, বন্ড অটোমেশন সফল করতে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান আবদুর রহমান খান।
** ‘প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত ভ্যাট নিরীক্ষা বন্ধ থাকবে’
** কাস্টমসে মিথ্যা-ভুল ঘোষণার জরিমানা অর্ধেক হচ্ছে
** ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়, হয়রানি চায় না
** কাস্টমসের হয়রানি ও আয়করে নিরীক্ষার নামে হয়রানি বন্ধ চান ব্যবসায়ীরা
** ‘শুল্ক নিয়ে ব্যবসায়ীদের সমস্যা আমরা দেখব’
** এনবিআরের বিভিন্ন দপ্তরে নিরীক্ষায় অসহযোগিতা
** কাস্টমসের হয়রানি ও আয়করে নিরীক্ষার নামে হয়রানি বন্ধ চান ব্যবসায়ীরা
** অডিটে আগে অডিট হয়নি এমন ফাইল বাধ্যতামূলক
** আয়করে অডিট চালু, ১৫৪৯৪ মামলা সিলেকশান
** ১৬৫৭২ অভিযান, ৯৯৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়
** অডিট দুর্বলতায় অর্থপাচার ও ঋণ খেলাপি বেড়েছে
** রাজস্ব বাড়াতে প্রকল্প: ‘ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়নি সরকার’
** কর কর্মকর্তারা ৪৫% কোম্পানি থেকে ঘুষ চেয়েছিলেন
** রিটার্ন না দিলে ব্যাংক হিসাব তলব হবে: চেয়ারম্যান
** কর-জিডিপি অনুপাত উদ্বেগজনক, কারণ কর ফাঁকি