ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়, হয়রানি চায় না

বর্তমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পেক্ষাপটের কারণে আমাদের স্থানীয় অর্থনীতিতে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ব্যবসায়িক হয়রানি, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার, আয়কর ও ভ্যাট প্রদানে জটিলতা এবং অসহনীয় যানজটের কারণে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশানুরূপ নয় বলে মত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সেজন্য ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সহজ ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নত করার দাবি জানিয়েছেন তারা। ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়, কিন্তু আমরা কোনও হয়রানি চাই না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মপুর ও আদাবর অঞ্চলের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিরূপন ও করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে শনিবার (২৬ এপ্রিল) টোকিও কনভেনশন সেন্টারে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা এই আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্ভূত নানা চ্যালেঞ্জ, কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট, আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতা এবং সর্বোপরি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যার ফলে বিশেষকরে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমাদের এসএমইখাতের উদ্যোক্তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

তাসকীন আহমেদ বলেন, ডিসিসিআই’র পক্ষ হতে আসন্ন বাজেটে উৎসে করের হার যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা, মূসক হার সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ ও অনানুষ্ঠানিকখাতের জন্য ১ শতাংশ হারে মূসক নির্ধারণ এবং ভ্যাট আপ চালুর প্রস্তারের পাশাপাশি সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন হবে, সেই সাথে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আহরণ। তিনি আরো বলেন, শিল্পায়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রাপ্তি প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অটোমেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গতিশীলতা আনায়ন এবং সরকরের পক্ষ হতে যুগোপযোগী নীতি সহায়তার কোন বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়, কিন্তু আমরা কোনও হয়রানি চাই না। আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে তিনি বলেন, যে কোন স্তরে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে আইনের শাসন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক (এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রাম্স ডিপার্টমেন্ট) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশেষকরে এসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৭ই মার্চ একটি মাস্টার সার্কুলার প্রদান করা হয়েছে। যেখানে এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তির সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেয়াদী ঋণের সময়সীমা ৫ বছর থেকে ৭ বছরে উন্নীত করা হয়েছে। এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন স্কীমের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে, যেখানে এখাতের উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। আর নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এ ঋণের হার মাত্র ৫ শতাংশ। বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধিকল্পে ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও (সিআরআর) সাড়ে ৫ শতাংশ হতে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (পশ্চিম)-এর অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিলন শেখ বলেন, সরকারের মোট রাজস্বের প্রায় ৮০ শতাংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরণ করতে হয়, যা অত্যন্ত দূরূহ একটি কাজ। মোহাম্মদপুর ও আশাপাশের এলাকায় এবছর ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত ৩ মাসে এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাটের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা এবং ভ্যাট আদায় বৃদ্ধিতে মোবাইল অ্যাপ প্রবর্তনের প্রস্তাব সরকার ইতিবাচক ভাবে বিবেচনা করতে পারে। ভ্যাটের বিষয়টিকে জটিল ভেবে দূরে না থেকে এ বিষয় জানার পরিধি বাড়ানোর জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (তেজগাঁও বিভাগ) মো. আলমগীর কবির বলেন, গত দুইমাসে এ অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সেই সাথে মামলার পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। গত ২৭ মার্চে পুলিশের ব্লক রেইডের মাধ্যমে ৬৩ জন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্প্রতি শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর এলাকায় একদিনে বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় ৭১ জনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এ এলাকায় এক্টিভ পুলিশিংয়ের আওতায় ৬৩টি প্রেট্রোলিং প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও অপরাধ নিমূর্লে জনগণকে তথ্য দিয়ে সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং আসন্ন কোরবানি উপলক্ষে মোহাম্মদপুরের শপিংমলগুলোতে নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে অবহিত করার এলাকাবাসী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।

মুক্ত আলোচনায় টোকিও স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সদস্য মোহাম্মদ হীরু এবং ফারুক আহমেদ, রাপা প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সভাপাতি মোতাহার হোসেন, টাউন হল বাজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি লুৎফর রহমান বাবুল, বাংলাদেশ ব্রিকস অ্যাসোসিয়েশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. লুৎফর রহমান (বাবুল) এবং ট্যাক্স কনসালটেন্ট প্রবীর কুমার পাল, এফসিএ প্রমুখ অংশ গ্রহণ করেন। ভ্যাট প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি, ভ্যাটের অ্যাপ প্রবর্তন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, চাঁদাবাজি বন্ধ, যানজট নিরসন, ঋণের সুদের হার হ্রাস ও ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি হ্রাস প্রভৃতি বিষয়ে উপর জোরারোপ করেন উপস্থিত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!