** অদক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিং, নাজুক নিরাপত্তা ও যানজটসহ ১২ ধরনের ত্রুটি-অনিয়ম
নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালান, আমদানি-রপ্তানির পণ্য ওজনে কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি, চাঁদাবাজি, চুরি-সবই চলে বেনাপোল স্থলবন্দরে। নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নষ্ট স্ক্যানার, কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে অদক্ষতা ও কারসাজি এবং যাত্রী টার্মিনালে অব্যবস্থাপনার সুযোগে চলে এসব অনিয়ম।
আমদানি-রপ্তানির মালামাল লোড-আনলোড করতে নিয়মের বাইরে প্রতিটি ট্রাক থেকে আদায় করা হয় ৬০০ থেকে ২০০০ টাকা। দীর্ঘদিন স্ক্যানার অকেজো থাকায় বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক এবং যানবাহনের বিভিন্ন স্থানে কুঠুরি তৈরি করে চলে চোরাচালান। ম্যানুয়ালি মালামাল ওজন করার সুযোগে করা হয় জালিয়াতি।
এর মাধ্যমে ফাঁকি দেওয়া হয় রাজস্ব। স্থলবন্দর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এবং স্থানীয় সিন্ডিকেট এর সঙ্গে জড়িত। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ওই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিন সদস্যের কমিটি। প্রতিবেদনে অদক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা, যানজট, জলাবদ্ধতাসহ ১২ ধরনের ত্রুটি-অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অব্যবস্থাপনা-অনিয়মের কারণে আমদানি-রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। যাত্রীসেবার বিষয়ে এতে বলা হয়, পদ্মা সেতু চালুর পর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে যাত্রীদের যাতায়াত বেড়েছে। তাদের বিশ্রামের স্থান, শৌচাগার ও সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। চারটি মাত্র ইমিগ্রেশন কাউন্টার এবং একটি স্ক্যানার সচল। অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে যাত্রীসেবা দিতে বিলম্ব হয়। প্রায়ই যাত্রীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এমনকি ভবনে ভাঙচুর চালান। প্রতিবেদনে বন্দরে নিরাপত্তা জোরদার, অবকাঠামো উন্নয়নসহ ২৫টি সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিগত অনেক বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যা রয়েছে বেনোপোল বন্দরে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অনেক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, স্থলবন্দর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সেখানে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। আমরা সেই পদক্ষেপও নিচ্ছি।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে সচল রয়েছে ১৬টি। সবচেয়ে বেশি আদমানি-রপ্তানি ও যাত্রী যাতায়াতকারী বন্দরগুলোর অন্যতম যশোর জেলায় অবস্থিত বেনাপোল স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মালামাল আমদানি-রপ্তানি হয়। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ বাংলাদেশি এবং ৫০০-৬০০ ভারতীয় ট্রাক আসে।
যে কারণে তদন্ত : জানা গেছে, বাস্তবায়নাধীন ‘বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজে অনিয়ম হয়েছে-এমন ভিডিও, স্থিরচিত্র ও অভিযোগ পান নৌ উপদেষ্টা। ওই অভিযোগের সত্যতা তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি বন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সুপারিশ জমা দিতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিদুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুন্সী মো. মনিরুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে বিআইডব্লিউটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমজাদ হোসেনকে সদস্য করা হয়। তবে নির্মাণকাজে অনিয়মের যে অভিযোগ ওঠে তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওপেন ইয়ার্ডে রডের পরিবর্তে বাঁশ দেওয়া এবং রড ছাড়াই ঢালাই দেওয়ার অভিযোগের প্রমাণ হিসাবে যে ভিডিও এবং স্থিরচিত্র জমা দেওয়া হয়েছে তা ওই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অর্থাৎ অন্য এলাকার ভিডিও এখানকার হিসাবে চালিয়ে দিয়েছে।
কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে অদক্ষতা-অনিয়ম : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় বছর আগে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদার ২-৩টি পুরনো ক্রেন, ফর্কলিফট ও অন্যান্য কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি দিয়ে ট্রাক থেকে মালামাল লোড-আনলোড করে। এগুলোর ভারোত্তোলনের ক্ষমতা তুলনামূলক কম এবং প্রায়ই নষ্ট থাকে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানিকারকদের ওয়েটিং টাইম বেশি লাগে। এসব নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। অথচ এসব কাজের জন্য ঠিকাদারকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তারপরও এই ঠিকাদারের লোকজন ট্রাক থেকে মালামাল লোড-আনলোডে ৬০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। টাকা না দিলে ওই ট্রাকের মালামাল লোড বা আনলোড করে না।
নাজুক নিরাপত্তা, চাঁদাবাজি ও চুরি : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেনাপোল বন্দর প্রথম শ্রেণির কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক। কেপিআই নীতিমালা মানা হয় না। বন্দরের নিরাপত্তায় পিমা সিস লিমিটেড নামের আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের ১২৯ জন নিরাপত্তাকর্মী চুক্তিভিত্তিক কাজ করে। এছাড়া আনসার বাহিনীর ১২৩ জন সদস্য রয়েছেন। বন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদ নেই। একক কমান্ড না থাকায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে সমন্বয় নেই। বন্দরে অননুমোদিত মানুষের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ নেই। শত লোক বিনা বাধায় ঢুকছেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন, ঘোরাঘুরি করছেন এবং আড্ডা দিচ্ছেন। এছাড়া বন্দরের বাইরের সড়কে অপেক্ষমাণ ট্রাকে রাতে পাহারা দেওয়ার নামে চাঁদা তোলেন স্থানীয় সংঘবদ্ধ চক্র। চাঁদা না দিলে ট্রাক শ্রমিকদের হেনস্তা করা হয়। ‘নাইটগার্ড বাহিনী’ নামে খ্যাত ওই চক্রের সদস্যরা গাড়ির যন্ত্রাংশ ও মালামালও চুরি করে।
চোরাচালান : বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে চোরাচালানের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাত্রী টার্মিনালে স্থাপিত রাজস্ব বোর্ডের স্ক্যানারটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। এই সুযোগে বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে আসল পণ্য না এনে নিষিদ্ধ মালামাল বহন করা হয়। এছাড়া গাড়ির ইঞ্জিন, চেসিস ও চালকের কেবিনের বিভিন্ন স্থানে গোপন কুঠুরিতে চোরাচালানের পণ্য পরিবহণ করা হয়। এই চোরাচালান সিন্ডিকেটে বন্দরে আসা যানবাহন, পরিবহণ শ্রমিক, বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একটির অংশের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, স্থলবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বেনাপোল অবস্থান করেন না। তাদের পক্ষে চুক্তিতে ভাড়ায় অন্য লোক কাজ করে, যা অবৈধ। এসব ব্যক্তি স্থানীয়ভাবে ‘এনজিও’ নামে পরিচিত। চোরাচালানের সঙ্গে এসব ব্যক্তির মধ্যে কারও কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা বন্দরের ভেতরে বসেই চোরাচালানে সহায়তা করেন।
ওজন জালিয়াতি, রাজস্ব ফাঁকি : এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বন্দরে পাইলট প্রকল্প হিসাবে অটোমেশন কার্যক্রম ২০২০ সালে চালু হলেও সিস্টেমের বিভিন্ন ত্রুটি ও প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতার কারণে ওয়েব্রিজ স্কেলে পণ্য পরিমাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়নি। বিভিন্ন কৌশলে দীর্ঘদিন ওজন জালিয়াতি করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। এ জালিয়াতির সঙ্গে বন্দরে কর্মরত সব মহলের কিছু ব্যক্তি ও বন্দর ব্যবহারকারীদের অনেকেই জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।