২০১৯ সালে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে বেঙ্গল সিমেন্ট লিমিটেড। তবে সাত বছরের মাথায় আর্থিক সংকটে পড়ে কারখানা বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর থেকেই কোম্পানিটি রুগ্ণ হয়ে পড়ে, আর চলতি বছরের এপ্রিলে চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মোরশেদ আলম গ্রেফতার হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাংকের দায়দেনা শোধ করতে কারখানা বিক্রির চেষ্টা চলছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে ১৭২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বেঙ্গল সিমেন্টের কারখানাটি ২০১৪ সালে নিবন্ধিত হয়। এর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৪ লাখ টন, যা বাড়িয়ে ২০ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল কোম্পানির।
বেঙ্গল সিমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম নোয়াখালী-২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন ফিরোজ আলম। এছাড়া মোরশেদ আলমের ভাই, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন এবং তাঁর ছেলে সাইফুল আলম পরিচালক হিসেবে যুক্ত আছেন। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেঙ্গল গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিরা রাজনৈতিকভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মোরশেদ আলম এ বছরের ৮ এপ্রিল গ্রেফতার হন। তবে তাঁর ভাই জসিম উদ্দিনকে গত বছরের আগস্টের পর থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
সম্প্রতি বেঙ্গল সিমেন্ট কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, এর উৎপাদন কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে থেকেই কারখানাটি ধীরে ধীরে রুগ্ণ অবস্থায় পড়ে। এক মাস ধরে এটি পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
কারখানার স্থানীয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক জনপ্রতিনিধি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষ দিকে থেকেই মিলটি অনিয়মিতভাবে চলছিল—কখনো এক মাস চালু থাকত, আবার কিছুদিন বন্ধ থাকত। তবে সম্প্রতি একটানা এক মাস ধরে মিল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে এবং কোনো উৎপাদন হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, কারখানাটি বিক্রি করার বিষয়ে কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে দু-একজন সম্ভাব্য ক্রেতা এসে কারখানাটি পরিদর্শনও করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ব্যবসায়িক সংকটে পড়ে বেঙ্গল সিমেন্ট। কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়েও চাপের মুখে পড়তে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানাটি লে-অফ ঘোষণা করা হয়নি, তবু শ্রমিকদের বড় অংশকে দুই মাসের বেতন পরিশোধ করে ছাঁটাই করতে হয়েছে, যা কোম্পানির আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়েছে।
বর্তমানে কেবল কিছু অপরিহার্য কর্মী রাখা হয়েছে, যাতে সম্ভাব্য ক্রেতারা পরিদর্শনে এলে কারখানা চালু করে দেখানো যায়। ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৭০ কোটি টাকা, যা বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক ও ইউসিবি ব্যাংক থেকে নেওয়া। এসব দেনা পরিশোধের জন্য মালিকপক্ষ কারখানাটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্পগোষ্ঠী ইতোমধ্যে কারখানাটি পরিদর্শন করেছে। পাশাপাশি আরও কয়েকজন সম্ভাব্য ক্রেতা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ব্যাংকের দায়-দেনাসহ কারখানাটির মূল্য ৬০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তবে ৫৫০ কোটি টাকা প্রস্তাব পেলেও বেঙ্গল গ্রুপ এটি বিক্রি করতে রাজি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেঙ্গল সিমেন্ট লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) খন্দকার আতাউর রহমান রিফাত বলেন, এ বছরের ১৮ জানুয়ারি থেকে অধিকাংশ সময়ই কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে সমস্যা এবং আর্থিক সংকটের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবেও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না এবং সেটি বিক্রির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি জানান, একসময় কারখানায় প্রায় দুই হাজার শ্রমিক থাকলেও বর্তমানে শুধু উৎপাদন সচল রাখতে প্রয়োজনীয় কিছু কর্মী রাখা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এবং বিক্রি সম্ভব না হলে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পুরো কারখানা লে-অফে যেতে হবে।
আইনানুযায়ী কোনো কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করার ক্ষেত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বেঙ্গল সিমেন্টের কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকা, শ্রমিক ছাঁটাই এবং বিক্রির উদ্যোগ সম্পর্কে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অবগত নয় বলে জানা গেছে।