** মোহাম্মদী গ্রুপের ৩ প্রতিষ্ঠান, কেডিএস, এসকিউ, কেয়া, ডিবিএল, নাসা, নিপা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে
** টাকা ফিরিয়ে না আনায় প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শেয়ার হোল্ডারদের করফাঁকি তদন্ত এবং প্রতিষ্ঠানের তদন্ত করার অনুরোধ
৯৯ বন্ডেড প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু দেশে আসেনি প্রায় ৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার; যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯২০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা থেকে ২৭২ কোটি টাকা পর্যন্ত রপ্তানির টাকা দেশে আসেনি—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩২টি। এই ৩২টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৮৬০ কোটি টাকা দেশে ফেরত আনেনি। এর মধ্যে দেশের বৃহত্তম বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে নয়টি। নয়টি প্রতিষ্ঠান দেশে ফিরিয়ে আনেনি প্রায় ৬৬১ কোটি টাকা। রপ্তানির ১২০ দিনের মধ্যে পিআরসি আসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ দুই বা আড়াই বছরেও টাকা আসেনি। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর) কমিশনারেটের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। একইসঙ্গে এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের আয়কর ফাঁকি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর শুল্ককর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে ওই বন্ড কমিশনারেট থেকে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন ও চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। এই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানি করার ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসে। কিন্তু রপ্তানি পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে পিআরসি আসার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু লিয়েন ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি মূল্য না আসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন মনিটরিং সিস্টেমে ওভারডিউ হিসেবে প্রদর্শিত হয়। বন্ড কমিশনারেট ২০৩টি প্রতিষ্ঠান যাচাই করে দেখেছে। যার মধ্যে ১০৪টি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির ডলার দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে। বাকি ৯৯টি প্রতিষ্ঠানের ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৪ ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ৯২০ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭১২ টাকা (১ ডলার ১১৮ টাকা) দেশে আসেনি। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি ৩২টি প্রতিষ্ঠানের ৮৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৮ হাজার ৯৫৫ টাকা দেশে আসেনি। এনবিআরের ২০২১ সালের এক আদেশ অনুযায়ী, কোন বন্ডেড প্রতিষ্ঠান ১ কোটি বা তার বেশি শুল্ককর ফাঁকি দিলে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক, শেয়ারহোল্ডারদের আয়কর ফাঁকি রয়েছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি রয়েছে কি না—তা সিআইসি ও শুল্ক গোয়েন্দা দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আয়কর ফাঁকি ও প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হয়েছে।
অপরদিকে, প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের নয়টি প্রতিষ্ঠান পণ্য ৫ কোটি ৬০ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৯ দশমিক ১৪ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। যা বাংলাদেশি টাকায় ৬৬১ কোটি ৫২ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ টাকা (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা হিসেবে)। নয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ২৫ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৬ দশমিক ২১ ডলার (২৯ কোটি ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৯৫২ টাকা), ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৭৭৭ দশমিক ৬৫ ডলার (২০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬২ টাকা), বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লি. ১ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার ২৩৬ ডলার (২২৪ কোটি ৫৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৪৮ টাকা), অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লি. ২ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪ ডলার (২৭১ কোটি ৮১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫২ টাকা), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট লি. কোম্পানি লি. ৭৫ হাজার ৫৬৪ ডলার (প্রায় ৮৯ লাখ টাকা), অ্যাসেস ফ্যাশনস লি. ৩৮ লাখ ২২ হাজার ১৮৭ ডলার (৪৫ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৬৬ টাকা), পারলেস গার্মেন্টস লি. ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ ডলার (২৩ কোটি ৫৮ লাখ ২৩ হাজার), ইলহাম ফ্যাশন লি. ৮ লাখ ১৬ হাজার ৬৪৩ ডলার (৯ কোটি ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৩৪ টাকা)। নয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ২০২২ ও ২০২৩ সালে পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীর ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে খুদে বার্তা দেওয়া হলেও জবাব দেননি।
অপরদিকে, নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ড্রেসেস লি.। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লাখ ৭ হাজার ৮৪৭ দশমিক ২১ ডলারের (১১ কোটি ৮৯ লাখ ২৫ হাজার ৯৭০ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু দেশে কোন টাকা আসেনি। দেশে টাকা প্রত্যাবাসিত না হওয়ার কারণ জানতে চেয়ে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেডিএস অ্যাকসেসরিজ লি. (ইউনিট-২)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ২০ দশমিক ৩৬ ডলারের (প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।
অপরদিকে, এস কিউ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস কিউ বিরিচিনা লি.। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৩ দশমিক ১২ ডলারের (প্রায় ৬৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে আসেনি। প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে এস কিউ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম ফারুকের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
কেয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেয়া কসমেটিকস লি.। প্রতিষ্ঠানটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৩১ দশমিক ৮৯ ডলারের (প্রায় ১৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু দেশে টাকা আসেনি। প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক পাঠানের নাম্বারে ফোন দেওয়া হলে তিনি জানান, রপ্তানির ডলার দেশে এসেছে। তবে তিনটি ব্যাংকের কারণে আমার ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে ডলার জমা হয়নি। এর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক ২৬৬ মিলিয়ন ডলার, ন্যাশনাল ব্যাংক ১২০ মিলিয়ন ডলার ও পূর্বালী ব্যাংক ১৩ কোটি ডলার। তিনটি ব্যাংকের কারণে আমার ফ্যাক্টরি ও রপ্তানি বন্ধ।
অপরদিকে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কালার সিটি লি.। প্রতিষ্ঠানটি ৯৬ হাজার ২৯৮ দশমিক ৭০ ডলারের (প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। আজিম অ্যান্ড সন (প্রা.) লি. ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৫২ দশমিক ৪৭ ডলার (প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা), উইনওয়্যার লি. ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪২ দশমিক ৬২ ডলার (প্রায় ৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা), ফ্রেন্ডস স্টাইল ওয়্যার লি. ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪২০ দশমিক ২৫ ডলার (প্রায় ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা), সোয়ান নিট কম্পোজিট লি. ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬৪ ডলার (প্রায় ৩৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা), কটস বাংলাদেশ লি. ৭ লাখ ৮ হাজার ৬৩৭ ডলার (প্রায় ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা), ক্লাসিফিয়া ফ্যাশন লি. ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭২২ ডলার (প্রায় ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা), প্যানাসি নিটেড ক্রিয়েশানস লি. ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৪৬ ডলার (প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা), সুপ্তি সুয়েটার লি. ১ লাখ ২৮ হাজার ২৬০ ডলার (প্রায় ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা), আরবান ফ্যাশন লি. ১ লাখ ২০ হাজার ৫১৩ ডলার (প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা) দেশে আনেনি।
অপরদিকে, নিপা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কে সি জ্যাকেট ওয়্যার কোম্পানি ২ লাখ ৭৭ হাজার ২৯৫ দশমিক ৯৩ ডলারের ( প্রায় ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। মন্ডল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আলিম নিট (বিডি) লি. ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৩৬ দশমিক ২০ ডলারের (প্রায় ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও টাকা দেশে আসেনি। স্টফাটেক্স ফ্যাশন লি. ৬ লাখ ৬ হাজার ১৮৭ দশমিক ৩৯ ডলারের ( প্রায় ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। আমেরিকান অ্যান্ড ফ্রাইড (বাংলাদেশ) লি. ১ লাখ ১২ হাজার ৭৬২ দশমিক ১৪ ডলারের (প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। সীমা ফ্যাশন ১ লাখ ১৬ হাজার ৯ দশমিক ৬৮ ডলারের (প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিএসএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়েমার্ট অ্যাপারেলস লি. এক লাখ ৩ হাজার ৪৯৮ দশমিক ৯৯ ডলারের (প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ জুন পর্যন্ত এই ওভারডিউ হয়েছে। টাকা কেন দেশে আসেনি—এই বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রাশেদুল হাসান মাসুদ বলেন, ‘পেমেন্ট আসেনি, এটা আমি প্রথম আপনার থেকে শুনলাম। যখন আমি জানবো, তখন জানাবো।’ কারণ দর্শানোর নোটিশ সম্পর্কে জানেন না তিনি।
***