একটি খাতে ৪০টি কোম্পানি থাকলেও, এর মধ্যে মাত্র তিনটি কোম্পানি ৪০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ধরে রেখেছে এবং তারা রাজস্ব দিচ্ছে ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে, বাকি ৩৭টি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে ৬০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার রাখলেও, তাদের রাজস্ব প্রদানের পরিমাণ মাত্র ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, এই কোম্পানিগুলো কোনো না কোনোভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, যা মার্কেট শেয়ার ও রাজস্ব প্রদানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পরামর্শ দিয়েছে, সংশ্লিষ্ট খাতের কোম্পানিগুলোর মার্কেট শেয়ার ও রাজস্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর ফাঁকির বিষয়টি চিহ্নিত করার জন্য।
ফিকি উদাহরণ হিসেবে দেশের বিলিয়ন ডলারের শিল্পগ্রুপগুলোর মার্কেট শেয়ার ও রাজস্ব প্রদানের তথ্য বিশ্লেষণের জন্য এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগকে অনুরোধ করেছে। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এই অনুরোধ জানানো হয়। মূলত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রাজস্ব আদায়ের অসমতা দূর করতেই ফিকির এই সুপারিশ।
উল্লেখ্য, দেশে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি বা শিল্পগ্রুপের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে তাদের মার্কেট শেয়ারও। বর্তমানে শত কোটি ডলারের ক্লাবে রয়েছে আটটি শিল্পগ্রুপ— এমজিআই, আবুল খায়ের গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, বিএসআরএম গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ। এসব শিল্পগ্রুপের কেউ আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আবার কেউ রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সভার শুরুতে ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন, যার মধ্যে ছিল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে উৎসে কর যৌক্তিকীকরণ, ন্যূনতম কর প্রত্যাহারসহ অন্যান্য প্রস্তাব। তিনি বলেন, যদি রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং আদায় বিভাগ আলাদা করা যায়, তবে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর হবে, যা কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। এছাড়া তিনি পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের জন্য করহার কমানোরও প্রস্তাব দেন।ফিকির পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরে এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক স্নেহাশিস বড়–য়া বলেন, কর-শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ছেন। তিনি এ ক্ষেত্রেও ইটিডিএস, ই-রিটার্ন এবং রিটার্ন ফাইলিং ডেটাবেইসের মধ্যে সমন্বয় আনার প্রস্তাব দেন।
অপরদিকে একই প্রাক-বাজেট আলোচনায় প্রস্তাবনা দেয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন এমসিসিআই। সভায় এমসিসিআইর সভাপতি কামরান টি রহমান বেশ কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিগত অর্থবছরগুলোয় শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর হার ধারাবাহিকভাবে কমানো হলেও অর্থ আইন-২০২৪ অনুযায়ী নগদ লেনদেনের শর্তের কারণে কেউই এই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। দেশের অর্থনীতি ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক, যেখানে ব্যাংকিং নির্ভরতা সম্পূর্ণ নয়। ফলে বড় ও মাঝারি কোম্পানির জন্য এই শর্ত পালন করা অত্যন্ত কঠিন। কার্যকরী কর হারও অনেক বেশি, যা উৎসে কর কর্তন ও অননুমোদিত ব্যয়ের ফলে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। তাই কোম্পানির কর হারের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্ত বাতিল করা দরকার।
এমসিসিআই সভাপতি বলেন, বর্তমানে কর প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণী কাঠামো একীভূতভাবে কাজ করছে, যার ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি সুপারিশ করেন যে, যদি কর নীতি এবং কর প্রশাসন আলাদা করা যায়, তবে স্বাধীন এবং স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, যা ব্যবসা এবং বিনিয়োগের জন্য সুবিধাজনক হবে। এতে কর আদায়ের প্রক্রিয়ায় অপচয় এবং হয়রানি কমবে, এবং ব্যবসায়ীরা সহজে কর পরিশোধ করতে পারবে।
এমসিসিআই আরও প্রস্তাব দেয় যে, কর নীতি নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়ক হবে। এছাড়া, তারা কর ব্যবস্থাপনা অনলাইনভিত্তিক করার প্রস্তাবও দেয়। তাদের মতে, কর নির্ধারণ, আপিল, ট্রাইব্যুনাল এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া অনলাইনে চালু করা জরুরি। করদাতাদের নোটিশ প্রদান এবং শুনানিতে তাদের হাজিরা অনলাইনভিত্তিক হওয়া উচিত, যা ব্যবসায়ীদের অর্থ এবং সময়ের অপচয় কমাবে।
তিনি বলেন, এসএমই খাতের বিকাশের জন্য আলাদা করহার নির্ধারণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। টার্নওভার কর কমানোর মাধ্যমে এসএমই ব্যবসায়ীরা করের আওতায় আসতে উৎসাহিত হবে। দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে কাঁচামালের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর প্রস্তাবও দেন তিনি। এছাড়া, এসএমই খাতের জন্য ভ্যাটের ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট সুবিধা চালু করা হলে এই খাতের বিকাশ ঘটবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সভায় সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিয়মিতভাবে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করছেন, যার ফলে কাস্টমস সংক্রান্ত বেশ কিছু জটিলতার সমাধান করা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে যে, বিদেশ থেকে কম দামে আমদানি করলেও খালাসের সময় ‘ইনভয়েস’ বা আমদানি মূল্যের তালিকা থেকে দাম বাদ দিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা নিজের ইচ্ছামতো মূল্যায়ন করছেন।
এর জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা যখন প্রায়ই দেখছেন যে ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করছে, তখন তাদের প্রশিক্ষণই এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে তারা সন্দেহ করতে শিখুক। তাদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে, ‘তুমি ভাবো, হয়তো তারা সঠিকভাবে ডিক্লারেশন (মূল্য ঘোষণা) দিচ্ছে না’। যদি পরিস্থিতি আদর্শ থাকত, তাহলে তো ইনভয়েস অনুযায়ী সব কিছু হতো। কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়। এ সময় তিনি ব্যবসায়ীদের লেনদেনের সকল তথ্য না দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, যতদিন না আমরা সত্য ও ন্যায়ের ওপর দাঁড়াতে পারি, ততদিন আমাদের এই সমস্যাগুলো চলতেই থাকবে।