** বিমানে সোনা পাওয়া গেলে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, পরে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয় না
** বিমানের টয়লেট, সিটের নিচে বা টেকনিক্যাল জায়গায় বিমানের লোক ছাড়া যাত্রীর পক্ষে লুকানো সম্ভব নয়
** ২৭ অক্টোবর ইউএস বাংলার উড়োজাহাজে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে এয়ারলাইন্সের কেউ জড়িত কীনা, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—তা জানতে ইউএস বাংলাকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা
২০১৩ সালের ২৪ জুলাই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের কার্গো হোল্ড থেকে আটক হয় ১২৪ কেজি সোনা। এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার চালান আটকের ঘটনা। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এই সোনা আটক করে। নিয়ম অনুযায়ী মামলা হয়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষে বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দিয়েছে। কিন্তু বিমানের মধ্যে সোনা আটকের ঘটনায় বিমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থার অপর একটি বিমানের টয়লেটের মধ্যে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা ১০৬ কেজি সোনা আটক করা হয়। এটি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনা চোরাচালানের ঘটনা। সে সময় বিমানটি জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। কিন্তু ‘মুছলেকা’ নিয়ে বিমানটি ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে কিভাবে সোনা বিমানের মধ্যে প্রবেশ করলো—তার তদন্ত হয়নি, ব্যবস্থাও নেয়া হয়। এরপর বহুবার বিমান থেকে সোনা আটক হলেও বিমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এতো গেলো সরকারি বিমান সংস্থা। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর বিমানেও একইভাবে বহুবার বিশেষ কায়দায় লুকানো সোনা আটক হয়েছে। মুছলেকা দিয়ে বিমান ছাড়া হলেও ওই বিমান সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারি-বেসরকারি বিমান সংস্থার বিমানের কখনো সিটের নিচে, কখনো সিটের হাতল খুলে, কখনো বিমানের ক্যাটারিং, কখনো বিমানের টয়লেট—ইত্যাদি জায়গায় লুকিয়ে সোনা পাচারের সময় আটক হয়। কিন্তু ওই বিমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, সাধারণত একজন যাত্রী ইমিগ্রেশন শেষে বিমানে প্রবেশ করতে অল্প সময় পায়। ফলে এতো অল্প সময়ের মধ্যে একজন যাত্রীর পক্ষে বিশেষ কায়দায় সোনা লুকানো সম্ভব নয়। আবার বিমানের যেসব অংশ খুলে সোনা লুকানো হয়, তা বিমানের কর্মী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সম্ভব নয়।
তবে সোনা আটক হলেও ওই বিমানের এসব কর্মী বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সোনা চোরাচালান রোধ ও সোনা আমদানিতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবার নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেজন্য যে বিমানে সোনা আটক হবেন—সেই বিমান জব্দ করে আইনি ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। একইসঙ্গে, আটক বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) মামলায় আসামি করে আটক করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এই বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানসহ দেশের সব বিমান সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এনবিআর সূত্রমতে, সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর ব্যাংকক হতে আসা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান থেকে প্রায় ৬ কেজি ৯৬ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা। বিমানের ভেতরে বিশেষ কায়দায় এই স্বর্ণ লুকানো ছিলো। বিমানটি আটক করা হয়। পরে ইউএস বাংলার আবেদনের প্রেক্ষিতে ও যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিবেচনা করে বিমানটি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি নজরে এনবিআরের নজরে আসে। কারণ অতীতে যেকোন বিমানে সোনা আটক হলে ওই বিমান কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ কোন তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না। যার ফলে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যায়। বিমান ও বিমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাস্টমস গোয়েন্দাকে এনবিআর নির্দেশ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। ১২ নভেম্বর ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সকে চিঠি দেওয়া হয়। যাতে জানতে চাওয়া হয়, ২৭ অক্টোবর আটক হওয়ার সোনা আমদানির সঙ্গে তাদের এয়ারলাইন্সের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত কিনা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা—তা কাস্টমস গোয়েন্দাকে জানাতে অনুরোধ করা হয়। তবে ইউএস বাংলা এখন পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি বলে জানা গেছে। ইউএস বাংলার আরো কয়েকটি উড়োজাহাজ থেকে অনেকবার সোনা আটক করা হয়েছে।
অপরদিকে, কাস্টমস গোয়েন্দা ‘উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে সঙ্গে চেয়ে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ দেশের সকল এয়ারলাইন্সকে ১১ নভেম্বর একটি চিঠি দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন উড়োজাহাজের মাধ্যমে দেশে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে আসা সোনা কাস্টমস গোয়েন্দা আটক করে। পরবর্তীতে আটক করা সোনা ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়। কিন্তু যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিবেচনায় এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে উড়োজাহাজ অন্তবর্তীকালীন ছেড়ে দেওয়া হয়। চোরাচালানকৃত সোনা অনেক ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের বিভিন্ন পয়েন্ট যেমন—সীটের নিচে, বাথরুমে, বাথরুমের পাইপের নিচে, ক্যাটারিং এরিয়া, ল্যাগেজ সংরক্ষণের স্থান ইত্যাদি জায়গায় অভিনব কায়দায় লুকানো অবস্থায় পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত না থাকলে এই ধরনের অপতৎপরতা সংঘটন সম্ভব নয়। এর দায় এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। কাস্টমস গোয়েন্দা বিশ্বাস করে, এয়ারলাইন্স কতৃপক্ষ সচেতন ও কঠোর হলে এ ধরণের সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সেজন্য এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। ভবিষ্যতে, উড়োজাহাজে এ ধরনের সোনা চোরাচালান ঘটনা সংঘটিত হলে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে, ১১ নভেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হেল্প ডেস্ক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘চোরাচালানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি আমাদের এয়ারক্রাফটগুলো ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনে আমরা আইন করবো—যেসব এয়ারক্রাফটের বডির ভেতরে স্বর্ণ পাওয়া যাবে—সেগুলোর দায় এয়ারক্রাফট অথরিটিকে নিতে হবে। যেসব এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটবে—তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হবে। তারা এখানে (বাংলাদেশে) রুট পারমিট পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘দেশের বাজারে যে পরিমাণ স্বর্ণ আছে, আর বৈধভাবে যা আমদানি হয়, এর মধ্যে অনেক গ্যাপ।’
এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, উড়োজাহাজ থেকে সোনা পাওয়া গেলে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তা ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এমন কথা শুনিনি। ইতিমধ্যে যেসব এয়ারলাইন্স হতে সোনা আটক হয়েছে এবং এর সঙ্গে বিমানের কর্মীদের যোগসাজসের অভিযোগ পাওয়া গেছে—আমরা সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা আমাদের জানাতে বলেছি। যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ওই বিমানের প্রধান ব্যক্তি যেমন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়ী করে মামলা করার কথা ভাবছি। ভবিষ্যতে যেসব বিমানে সোনা আটক হবে এবং এর সঙ্গে ওই বিমানের কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে—তখন ওই বিমানের এমডি বা সিইওদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে।