বিনিয়োগ বন্ধ, ৩৬৬ কোটি জরিমানা নিল শেভরন

দেশে গ্যাসের উৎপাদন টানা কমতে থাকায় বেশি দামের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বেড়েছে। অথচ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর একটি প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। বিনিয়োগ বন্ধ রেখে চাপ দিয়ে বকেয়া বিলের পুরোটা আদায় করে নিয়েছে তারা। এরপরও কাজ শুরু না করে দেরিতে বিল শোধের সুদ (বিলম্ব মাশুল বা জরিমানা) আদায় করে নিয়েছে শেভরন। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস বিল জমা দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হয়; বিল দিতে দেরি হলে জরিমানা দিতে হয়। এবার মোট জরিমানা ৩ কোটি ডলারের বেশি (৩৬৬ কোটি টাকা, ১২২ টাকায় গুণ করলে) শোধ করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, শেভরন দেশের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র—বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ—থেকে গ্যাস উৎপাদন করে। প্রতি মাসে তাদের গড় বিল প্রায় চার কোটি ডলার। বিগত সরকারের সময় ডলার সংকটে বিল বকেয়া শুরু হলে শেভরন চাপ দিতে থাকে। সরকার পরিবর্তনের পর বকেয়া দাঁড়ায় ২৪ কোটি ডলার, যা পরিশোধে তারা নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রেখে চাপ সৃষ্টি করে। তিন দশক ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করা শেভরন বিভিন্ন সময়ে নানা সুবিধা পেয়ে আসলেও এ ধরনের আচরণ অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার একের পর এক কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের কাজ করছে। তবে শেভরন পরিচালিত তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমছে। সিলেটের জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে একটি কমপ্রেসর বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা এই বছরের ডিসেম্বরেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। চুক্তির মেয়াদও তারা বাড়িয়ে নিয়েছিল। তবুও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন বিনিয়োগ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে গড়িমসি করছে শেভরন। গত বছরের ৪ এপ্রিল শেভরন পেট্রোবাংলাকে একটি চিঠিতে জানিয়েছে, বকেয়া বিল পুরোপুরি শোধ না করা পর্যন্ত তারা জালালাবাদ কমপ্রেসর প্রকল্পে বিনিয়োগ স্থগিত রাখছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেয়। গত ১৭ এপ্রিল শেভরনের সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়। এর পর ২০ এপ্রিল পেট্রোবাংলা শেভরনকে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পটি শেষ হলে জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৩৫২ বিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে বলে শেভরন জানিয়েছিল। প্রকল্প সময়মতো শেষ না হলে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে এবং জালালাবাদ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। যেহেতু সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে, পেট্রোবাংলা আশা করছে শেভরন দ্রুত জালালাবাদে কাজ শুরু করবে।

শেভরনের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জিজ্ঞেস করা হয়, বকেয়া ও জরিমানা আদায়ের জন্য এ ধরনের চাপ সৃষ্টি করা কতটা নৈতিক, এবং বকেয়া ও জরিমানা শোধ হওয়ার পর তারা কবে কাজ শুরু করবে। এ প্রশ্নের উত্তরে শেভরনের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান জানান, সম্ভাবনার সুযোগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি নীতির আওতায় শেভরন বাংলাদেশ তাদের নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক পরিকল্পনা প্রকাশ করে না।

কোনো দেশে দীর্ঘদিন ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানিকে রাজনৈতিক উত্থান-পতন বিবেচনায় নিতে হয়। তবে এভাবে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করাটা ঔদ্ধত্য। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, বরং অনৈতিক। এখন পেট্রোবাংলার উচিত চাপ তৈরি করে দ্রুত কাজ শুরু করায় বাধ্য করা। শেভরন পরিচালিত তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের দুটিতে মজুত কিছুটা বেড়েছে। বিবিয়ানায় নতুন হিসাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ টিসিএফ। বর্তমানে মজুত আছে সোয়া এক টিসিএফ। আরও চার বছর উৎপাদন করার মতো গ্যাস আছে এখানে।

মৌলভীবাজারে বর্তমানে প্রায় ২০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস মজুত রয়েছে। দিনে এখান থেকে উৎপাদন হচ্ছে ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট, যা হিসেবে মজুতটি চার বছর পর্যাপ্ত। জালালাবাদে মজুত আছে প্রায় ৭০০ বিসিএফের কম, যেখানে দিনে উৎপাদন হচ্ছে ১২৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এ হারে উৎপাদন চালালে জালালাবাদ থেকে আরও দেড় বছর গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!