ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মালিকানাধীন সড়কে পার্কিং বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ফাইবার অ্যাট হোম’। প্রকাশ্যে ‘এলওসিসি’ নামের একটি সংস্থাকে সামনে দেখালেও, প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী এই প্রতিষ্ঠানটিই পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এলওসিসির তৎকালীন কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে আঁতাত করে ‘পাইলটিং’ প্রকল্পের নামে বিনাটেন্ডারে এলওসিসিকে কাজ দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে পার্কিং অ্যাপ পরিচালনা, অর্থ সংগ্রহ এবং ডাটা সংরক্ষণসহ পুরো কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রণ করে ফাইবার অ্যাট হোম। জানা গেছে, প্রায় ৮ মাসে ৪৮ হাজার ৬১৯টি যানবাহনের পার্কিং ভাড়া বাবদ ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫ টাকা আদায় করলেও ডিএনসিসি পায়নি কানাকড়িও। অথচ ‘অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং’ ব্যবস্থার মূল উপাদান-পার্কিং স্পটের মালিক ডিএনসিসি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৩ সালের আগেই ফাইবার অ্যাট হোম বেশ কয়েক বছর ধরে একটি স্ট্রিট পার্কিং সিস্টেম ডেভেলপ করে, যা পরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামোতে প্রয়োগের চেষ্টা চালায়। অবশেষে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের প্রত্যক্ষ মদদে ২০২৩ সালের নভেম্বরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। ডিএনসিসি, ডিএমপি, গুলশান ও বনানী সোসাইটি এবং গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এলওসিসির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অনস্ট্রিট স্মার্ট পার্কিং’ চালু হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা প্রমাণের বদলে, মেয়র আতিকের আশীর্বাদে বিনা প্রতিযোগিতায় ফাইবার অ্যাট হোম এ প্রকল্পের মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। এমনকি কার্যক্রম শুরুর আগে মুনাফার অংশ নির্ধারণ না করেই পাইলটিংয়ের নামে বিনাটেন্ডারে এলওসিসিকে কাজটি দেন তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলাম। প্রথম ৬ মাসের পাইলটিং শেষে এর মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ায় সিটি করপোরেশন। দ্বিতীয় মেয়াদে এই সেবা গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা ছিল। তবে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৭ জুলাইয়ের পর সেবার ‘অনগ্রাউন্ড’ কার্যক্রম থমকে যায়।
২০২৩ সালের ৮ আগস্ট ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ও এলওসিসির মহাসচিব রাফেজ আলম চৌধুরীর বরাবর অনুমতিপত্র ইস্যু করা হয়। ওই পত্রের ১৩ নম্বর শর্তে উল্লেখ ছিল যে, পার্কিং পরিচালনার উদ্বোধনের আগেই আদায়কৃত ফি ডিএনসিসি ও এলওসিসির যৌথ হিসাবে সংরক্ষণ করা হবে। তবে বাস্তবে এখনো কোনো যৌথ হিসাব খোলা হয়নি। ২০২৪ সালের ২০ মার্চ ডিএনসিসি ও এলওসিসির এক সভায় এই বিতর্কিত কার্যক্রমের পাইলটিং আরও ছয় মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফাইবার অ্যাট হোমের তৎপরতায় এলওসিসিকে অতিরিক্ত ৩৯টি সড়কে জরিপের অনুমতি দেওয়া হয়। একই সভায় প্রথমবারের মতো পার্কিং সেবার আয়ের বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে ৮৫ শতাংশ মুনাফা এলওসিসির জন্য এবং মাত্র ১৫ শতাংশ ডিএনসিসির জন্য নির্ধারিত হয়।
বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথমে গুলশানের আটটি সড়কে পার্কিং চালু করা হয়, যেখানে গাড়ির জন্য ৮৫টি এবং মোটরসাইকেলের জন্য ৩৬টি স্লট বরাদ্দ ছিল। তবে সূত্র বলছে, মোটরসাইকেলের তুলনায় গাড়ি পার্কিংয়ের চাহিদা ছিল বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি ক্রয় বিশেষজ্ঞ বলেন, অতীতে পাইলট প্রকল্পের নামে এমন নজির পাওয়া গেছে, যেখানে টেন্ডার ডকুমেন্ট এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে সংশ্লিষ্ট পাইলটিং প্রতিষ্ঠানই মূল প্রকল্পের কাজটি পাওয়ার সুবিধা পায়। ডিএনসিসির বর্তমান প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, পাইলটিংয়ের নামে কার্যক্রম চালিয়ে টেন্ডার এড়ানো এবং আয়ের অংশ গোপন রাখার বিষয়টি এখন স্পষ্ট। এটি সুস্পষ্ট দুর্নীতি; যেখানে সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে ফাইবার অ্যাট হোম কোটি টাকার বাণিজ্য চালিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে এলওসিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।ফাইবার অ্যাট হোমের কাছে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সরকারি এবং রেগুলেটরি বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, নগরবাসীকে উন্নত পার্কিং সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে অনস্ট্রিট পার্কিং সিস্টেম ডেভেলপ করা হয়েছে। এতে আমাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে। ব্যবসায়িক মডেল হিসাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পার্কিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণে আমরা প্রস্তুত আছি। তবে যেহেতু বর্তমান পাইলটিংটা অসম্পন্ন হয়ে আছে, তাই সম্পূর্ণভাবে শেষ করার জন্য আমাদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কেবল রাজস্ব নিশ্চিত করে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। পাশাপাশি, জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনের কোনো কাজ পাবে না বলেও তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।