বিচার ব্যবস্থায় ‘বকশিশ’ নির্ধারণ

টাকা ছাড়া ফাইল চলতে পারে না—এটি এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, হোক তা অফিস বা আদালত। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য অধিকারও প্রতিষ্ঠা করতে হয় ঘুষের মাধ্যমে, যদিও তা গোপনে হয়ে থাকে। তবে শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি এই প্রচলিত রীতি ভেঙে দিয়েছে। তারা সভা ডেকে রেজ্যুলেশন করে ঘুষকে বৈধতা দিয়েছে এবং ঘুষ বা বকশিশের পরিমাণও নির্ধারণ করেছে। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সমিতির সভার রেজ্যুলেশনের অংশ কিছু ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে, এটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

‘ল্যয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রেজ্যুলেশনটি প্রকাশ্যে আসে। এতে আদালতের বিভিন্ন স্তরে কোন কাজের জন্য পেশকার, পিয়নদের কত টাকা বকশিশ দিতে হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গত ৬ মার্চ সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় এ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ কামরুল হাসান উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, সভায় আলোচনা শেষে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে পেশকার বা পিয়নকে সিআর ফাইলিংয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা, যেকোনো দরখাস্ত (জিআর/সিআর) ফাইলে ১০০ এবং জামিননামা দাখিলে প্রতি মামলায় ১০০-২০০ টাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গারদখানায় ওকালতনামা স্বাক্ষরে ১০০, সিভিল ফাইলিংয়ে সর্বোচ্চ ২০০ ও হলফনামার জন্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করেছে সমিতি।

আদালতে ঘুষের পরিমাণ সহনীয় পর্যায় নামিয়ে আনা ও বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি ঠেকাতে সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দাবি করেন সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেম। তবে সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন অ্যাখ্যা দিয়ে বিচারবিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ ও খাটো করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির শেখ মহসিন স্বপন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আইনজীবী বলেন, বর্তমান কমিটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসেছে। তারা শুধু অযোগ্য নন, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া দেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ, তারাও ভালো করে জানেন। ঘুষকে বৈধতা দেওয়ার এখতিয়ার কোনো আইনজীবী সমিতির নেই। এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে।

শরীয়তপুর আদালতের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘সমিতির নতুন নির্বাহী কমিটি প্রথম সভাতে অবৈধ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘুষ বৈধ করায় সমিতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেও তারা আমলে নেননি। এ সিদ্ধান্তে দুর্নীতি ও বিচারহীনতার পরিবেশ আরও জটিল হবে।’

এই বিষয়ে সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম কাশেমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ৬ মার্চের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু মহলে ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে, যার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে আইনজীবী সমিতি। তিনি জানান, দুর্নীতিমুক্ত ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন। এটি কোনো রেজ্যুলেশন নয়, বরং অনিয়ম প্রতিরোধে একটি অভ্যন্তরীণ আলোচনা। তারা বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান এবং বিচারব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। আশা করেন, তার এই লেখার মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।

শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির শেখ মহসিন স্বপন বলেন, ‘সভা ডেকে ঘুষের পরিমাণ নির্ধারণ করে রেজ্যুলেশন নজিরবিহীন। আমরা বিস্মিত। তারা বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং খাটো করেছে। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর এমন লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে হঠাৎ কেন আমাদের কর্মীদের ঘুষের আওতায় আনা হলো, জানতে চাই।’

শরীয়তপুর কোর্ট পরিদর্শক শিমুল সরকার জানান, বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। এখানে ঘুষ লেনদেন হয় কিনা জানেন না। কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!