দেশের ইস্পাত খাতের জায়েন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম)। মিরসরাই কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনের কারণে স্থানীয় চার ইউনিয়ন ও এক পৌরসভায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিটি মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকায় বছর কয়েক আগে স্থাপন করেছে দেশের বৃহৎ বিলেট কাস্টিং প্লান্ট। এই প্লান্টে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস না থাকায় বিলেট উৎপাদনে মাটির নিচ থেকে হাইড্রোলিক রিগ বোরিংয়ের মাধ্যমে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করছে। আর তাতে আশেপাশের এলাকায় তীব্র পানি সংকট হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ইস্পাত খাতের শীর্ষ কোম্পানি বিএসআরএম কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকায় স্থাপন করে দেশের বৃহৎ বিলেট কাস্টিং প্লান্ট। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথমে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন বিলেট উৎপাদন সক্ষমতার একটি কারখানা সেখানে স্থাপন করা হয়। তার কিছুদিন পর একই এলাকায় পাঁচ লাখ টনের আরও একটি বিলেট কাস্টিং প্লান্ট স্থাপন করে এ শিল্পগোষ্ঠীটি। কিন্তু ওই এলাকায় তাদের চাহিদা মেটানোর মতো কোনো প্রাকৃতিক পানির উৎস ও সরবরাহকারী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে তারা মাটির হাজার ফুট গভীর থেকে বড় বড় পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করছে।
যদিও কারখানা তৈরির আগে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফেনী নদী থেকে পানি সংগ্রহের কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা না করে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে বিলেট উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। আর তাতে বারইয়ারহাট পৌরসভা, হিঙ্গুলী ইউনিয়ন, জোরাগঞ্জ ইউনিয়ন, ধুম ইউনিয়ন ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা বলছে, এক টন রড উৎপাদনে এক হাজার ২০০ লিটার পানি লাগে। সে হিসেবে বিএসআরএমের এই কারখানায় বছরে প্রায় ছয় কোটি ৩৬ লাখ তিন হাজার ঘনমিটার পানি লাগার কথা। কিন্তু আমরা সঠিক বলতে পারছি না তারা প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি উত্তোলন করছে। তবে এই কারখানা স্থাপনের পর থেকে এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হিঙ্গুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন হারুন, জোরাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোকসুদ আহম্মদ চৌধুরী, ধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ও দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান বিপ্লব একই রকম অভিযোগ করেন। এই ইউনিয়নগুলো বিএসআরএম সোনাপাহাড় কারখানার তিন পাশে অবস্থিত আর অন্য (পূর্ব) পাশে পাহাড় ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিজনেস বার্তাকে বলেন, বিএসআরএম সোনাপাহাড় এলাকায় কারখানা স্থাপনের পর থেকে পানির সমস্যাটা শুরু হয়েছে। তারা অধিক পরিমাণ পানি উত্তোলনের কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন গ্রামে আগে থেকে বসানো গভীর ও অগভীর মিলে কয়েক হাজার নলকূপে আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পানির তীব্রতর সংকট দেখা দিতে পারে। এমনকি সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাড়ির গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও সংসদ সদস্যের বাড়ি থেকে কারখানা কয়েক কিলোমিটার দূরে, এরপরও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
একই ধরনের মন্তব্য করেন নাছির উদ্দিন হারুন ও মোকসুদ আহম্মদ চৌধুরী। তারা বলেন, বিএসআরএম বিকল্প ব্যবস্থা না করলে চার ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার কয়েক লাখ মানুষের তীব্র পানি সংকট দেখা দেবে অচিরে।
এদিকে আবু সুফিয়ান বিপ্লব বলেন, আমার এলাকার সব জায়গায় এখনও পানি সংকট দেখা দেয়নি। কারণ দুর্গাপুর কারখানা থেকে একটু দূরে। কিন্তু বাকি ইউনিয়নে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার সমাধান করা না হলে আমার ইউনিয়নের অবশিষ্ট এলাকায়ও সংকট দেখা দেবে। তিনি বলেন, শুনেছিলাম বিএসআরএম ফেনী নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে কারখানায় ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা করছে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন বিজনেস বার্তাকে বলেন, সীতাকুণ্ড উপজেলায় যেরকম পানির সংকট আছে মিরসরাইতে সে রকম নেই। মিরসরাই অঞ্চলে ফেনী নদী ও মহামায়া লেক থেকে পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে। কারণ মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই সাত মাসে ১০১ দশমিক ২২ কোটি ঘনমিটার পানি ফেনী নদীতে উদ্বৃত্ত থাকে আর মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই ছয় মাস মহামায়া লেকে শূন্য দশমিক ৭১ কোটি ঘনমিটার পানি উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু মিরসরাইতে বিএসআরএম ব্যয়বহুল হাইড্রোলিক রিগ বোরিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের উদ্যোগে পানি উত্তোলন করছে। এতে আশেপাশের এলাকায় পানি সংকট দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। কারণ সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এলাকায় ২৮০ থেকে ৩০০ ফিট নিচে হেভি রক/সোল প্রবলেম থাকায় উপরের পানি নিচে নামে না। ফলে স্বল্প গভীরের নলকূপে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বাড়লেও গভীর নলকূপে পানির প্রভাব বাড়ে না। এতে পাশের এলাকায় পানি সংকটসহ ভূমিধস হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বিজনেস বার্তাকে বলেন, ‘পানি সংকট শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য হচ্ছে না। মিরসরাইতে আরও অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। কিন্তু মানুষ তাদের দেখছে না, আমাদের অভিযুক্ত করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা রিসাইক্লিং করে পানি পুনরায় ব্যবহার করছি। ফলে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের সুযোগ নেই। এছাড়া আমরা ফেনী নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার করণে অনুমতি এখনও পাওয়া যায়নি।’
তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের কারণে পানি সংকট হচ্ছে এমন মন্তব্য পুরোপুরি মানতে নারাজ বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, বিএসআরএম পাহাড় কাটা ও খাল ভরাট করার পাশাপাশি হাইড্রোলিক রিগ বোরিংয়ের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করছে। কারণ আশেপাশে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো এগ্রো ও ডেইরি জাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বিএসআরএমের মতো পানি প্রয়োজন হয় না। তিনি আরও বলেন, পৌরসভা এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আর নতুন করে নলকূপ বসানোর সময় আগের তুলনায় দ্বিগুণ খনন করেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।