** দেশের ভেতর প্রতিষ্ঠান আর প্রকল্পে পণ্য সরবরাহকে রপ্তানি দেখায়
** অবৈধভাবে রেয়াত নিয়েছে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা
** পণ্য সরববরাহ করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা
দেশের ইস্পাত খাতের র্শীষ বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম)। পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকি এবং অবৈধভাবে রেয়াত গ্রহণের অভিযোগ পুরনো। বিএসআরএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের রেয়াত গ্রহণ ও ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। নিরীক্ষা শেষে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআরে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে প্রতিষ্ঠানটির আলী হুসাইন আকবর আলীর নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দিলেও জবাব দেননি। মূসক গোয়েন্দার প্রতিবেদন বিষয়ে কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত বিজনেস বার্তাকে বলেন, ‘এ প্রতিবেদন বিষয়ে আমার জানা নেই। আমার চোখে পড়েনি, জিজ্ঞাসা করতে হবে।’ অবৈধ রেয়াত গ্রহণ বিষয়ে ডিএমডি বলেন, ‘আমরা আইনের বাইরে কিছুই করি নাই। বিএসআরএম হলো কমপ্লায়েন্ট, ট্রান্সপারেন্ট ও ইথিক্যাল ওরগানাইজেশন। এখন কেউ যদি আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে, সেটা হলো তৃতীয় ব্যক্তির ইন্টারপিটিশান করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বেআইনি কাজ কোনদিন করি না, এখনো করি না, আগামীতেও করবো না।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আদালতে বিচারানাধীন। একই বিষয়ের একটি মামলার উপর আর একটি মামলা করতে পারে কিনা আমার জানা নেই।’
এনবিআর সূত্র জানায়, দেশের স্টিল জায়ান্ট হিসেবে খ্যাত বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে স্থানীয় মূসকযোগ্য সরবরাহকে রপ্তানি দেখিয়ে বিধি বর্হিভূতভাবে বিপুল অঙ্কের রেয়াত নেয়ার অভিযোগ উঠে। একই কায়দায় ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গত বছরের ১৬ এপ্রিল মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয় এনবিআর। এরই প্রেক্ষিতে মূসক গোয়েন্দা কমিটি গঠন করে। কমিটি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যপর্ণ গ্রহণের স্বপক্ষে ব্যাংকের পিআরসি, আন্তর্জাতিক দরপত্র, মাসিক দাখিলপত্র ও অন্যান্য দলিলাদি জমা দিতে অনুরোধ করলে প্রতিষ্ঠান তা জমা দেয়। এসব যাচাই করে কমিটি সম্প্রতি প্রতিবেদন দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রপ্তানি (ড্র-ব্যাক) দেখিয়ে রেয়াত নিয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর নিয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর নিয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ তিন অর্থবছরে পর্যন্ত পণ্য রপ্তানি দেখিয়ে রেয়াত নিয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ তিন অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি ১৬ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮৯ মেট্রিক টন উপকরণ (কাঁচামাল) ক্রয় করেছে। এর মধ্যে আমদানি করেছে তিন লাখ ৯ হাজার ৩২৪ মেট্রিক টন। বাকি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন স্থানীয়ভাবে ক্রয় করেছে। এসময় প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৮৯২ মেট্রিক টন কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার করেছে। আর পণ্য উৎপাদন দেখানো হয় ১৬ লাখ ১৬ হাজার ২৫৩ মেট্রিক টন। আর বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৬ মেট্রিক টন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিএসআরএম স্টিল দাখিলপত্রে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট এক লাখ চার হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন এমএস প্রোডাক্টস রপ্তানি দেখিয়েছে। এর বিপরীতে রেয়াত নিয়েছে ১১৮ কোটি ৫৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৫২ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাইরে, বিভিন্ন ইপিজেডে অবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের ভেতর চলমান বিভিন্ন বিভিন্ন প্রকল্পে পণ্য সরবরাহকে রপ্তানি দেখিয়ে এ এ শুল্ককর রেয়াত নিয়েছে। এছাড়া ইপিজেডের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করে তাও রপ্তানি দেখিয়েছে। এর বিপরীতে আমদানি পর্যায়ে পরিশোধিত মূসক ও শুল্ককর রেয়াত হিসেবে গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি এ তিনবছরে ইপিজেডে ২৬ হাজার ২৫৩ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানির প্রায় ২৬ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার টাকার শুল্ককর রেয়াত নিয়েছে। এনবিআরের ১৯৯৪ সালের ২৫ আগস্টের সাধারণ আদেশে বলা হয়েছে, ইপিজেড এলাকায় কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ ঋণপত্র ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে নিমার্ণ সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। মূসক আইন, ১৯৯১ এর বিধি ১৯(৪) অনুযায়ী এক্ষেত্রে শুল্ককর রেয়াত নেয়া যাবে। এনবিআরের আদেশ ও মূসক আইন অনুযায়ী ইপিজেড এলাকায় পণ্য সরবরাহকে রপ্তানি হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে এ রেয়াত গ্রহণ বৈধ হবে।
অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি দেশের বাইরে তিন হাজার ৫৩০ মেট্রিন টন পণ্য রপ্তানির বিপরীতে শুল্ককর রেয়াত নিয়েছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা। বিদেশি রপ্তানির বিপরীতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আসলে মূসক আইন অনুযায়ী যাচাইপূর্ণ এ রেয়াত বিষয়ে বিবেচনা করতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া দেশের ভেতরে ইপিজেড ছাড়া গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানির বিপরীতে রেয়াত নিয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। দেশের অভ্যন্তরে পণ্য সরবরাহ করে তাকে রপ্তানি দেখানো মূসক আইনের পরিপন্থী বিধায় এ রেয়াত আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছে ৫৭ হাজার ৩৯০ মেট্রিক পণ্য সরবরাহকে রপ্তানি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি রেয়াত নিয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি সাত লাখ টাকা। এ রেয়াত গ্রহণ মূসক বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি ৩১ক মোতাবেক যথাযথ হয়নি। এতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় পণ্য সরবরাহ বা সেবা প্রদান বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রকল্পে পণ্য সরবরাহ করলে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রমাণ দেখাতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ফলে এ রেয়াত আইনানুগ হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছে বলে জানিয়েছে, যা বিচারাধীন। তবে রিট আদেশের পর সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ভেতরে ইপিজেড ছাড়া গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি দেখিয়েছে। প্রতি টনে ট্যারিফ মূল্য ছয় হাজার টাকা। এ হিসেবে এসব পণ্যের মূসক আরোপযোগ্য মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যার উপর প্রযোজ্য মূসক প্রায় এক কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রকল্পে ৫৭ হাজার ৩৯০ মেট্রিক পণ্য রপ্তানি দেখিয়েছে। প্রতি টনে ট্যারিফ মূল্য ছয় হাজার টাকা। এ হিসেবে এসব পণ্যের মূসক আরোপযোগ্য মূল্য প্রায় ৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ দুইটি খাতে রপ্তানির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি মোট মূসক ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ছয় কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর দুইটি খাতে মোট অবৈধভাবে রেয়াত নিয়েছে মোট ৮৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অবৈধভাবে রেয়াত আর মূসক ফাঁকিসহ প্রতিষ্ঠানটির কাছে মোট ৯৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এ রাজস্বের উপর ২ শতাংশ হারে সুদ প্রায় পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আদায়েরও সুপারিশ করা হয়েছে।