বিএনপি নেতাদের পকেটে যাবে ৪১৮ কোটি টাকা

ময়লা বাণিজ্য

গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ পরিচ্ছন্নতা কর হিসেবে আদায় করেছে ১৩১ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পরিচ্ছন্নতা কাজে চসিকের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার জনবল, যার মধ্যে ২ হাজার জন ঘরে ঘরে গিয়ে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহের জন্য একসঙ্গে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তবে এখন এই কাজটি তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এসব প্রতিষ্ঠান নগরবাসীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায় করবে। অভিযোগ উঠেছে, এসব কাজ দেওয়া হয়েছে বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। ইতোমধ্যে ১৯টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে। হিসাব বলছে, এই খাতে বছরে প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য করবে প্রায় ৪১৮ কোটি টাকা।

এই লাভজনক বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবসা থেকে সিটি করপোরেশন নামমাত্র অর্থ পাবে—এমনটাই জানা গেছে। ফলে এ খাত নিয়ে নৈরাজ্য ও দুর্বৃত্তায়নের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এসব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে দায়িত্ব তুলে দিলে নাগরিকদের কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতা কর আদায় না করার দাবি জানিয়েছেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের নেতারা।

চসিক ৪১টি ওয়ার্ডে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এতে ১৯১টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়, যার অধিকাংশই বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মালিকানাধীন। দরপত্র মূল্যায়নের পর ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে ১৯টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাকি ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কাজ এখনও প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নাম জানা গেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ডের কাজ পেয়েছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব জমির উদ্দিন নাহিদের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাতৃভূমি এন্টারপ্রাইজ, ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে নগর যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী সাকির প্রতিষ্ঠান এসআরএস এন্টারপ্রাইজ, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন নাবিলের প্রতিষ্ঠান নাবিল এন্টারপ্রাইজ, ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এন মো. রিমনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিমন কনস্ট্রাকশন, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি হুমায়ুন কবির চৌধুরী রুদ্রের প্রতিষ্ঠান অ্যাকুয়া রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলাউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মদিনা এন্টারপ্রাইজ, ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডে নগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ খান, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে যুবদল নেতা মো. ইমতিয়াজুর রহমানের প্রতিষ্ঠান গ্রিন এন্টারপ্রাইজ, ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসম্পাদক ফারহান ফুয়াদের প্রতিষ্ঠান বিন ফুয়াদ এন্টারপ্রাইজ এবং ৩৭ নম্বর উত্তর মধ্যম হালিশহরে সাবেক ওয়ার্ড ছাত্রদল নেতা শাহিনূর ইসলামের প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এ ট্রেডার্স।

এছাড়াও রয়েছে ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের দায়িত্ব পেয়েছে বিএনপি সমর্থিত জামসেদ হোসেনের প্রতিষ্ঠান লাইমেক্স মাল্টি ট্রেড, ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে মোস্তফা মো. জাবেদের প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহ আমানত ট্রেডিং, ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে শাহজাহানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স গাউসিয়া ট্রেডার্স ও ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে মো. জিয়া উদ্দীন জাবেদের প্রতিষ্ঠান নগর সেবা। সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) মহসিনুল হাবিব পেয়েছেন ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড ও ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের কাজ।

৪১৮ কোটি টাকার বাণিজ্য

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হিসাব অনুযায়ী, নগরে হোল্ডিং রয়েছে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার। এসব হোল্ডিংয়ে গড়ে ৬টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। প্রতি ফ্ল্যাট থেকে যদি গড়ে ৭০ টাকা করে আদায় করা হয়, তাহলে মাসে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ আয় হবে প্রায় ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা বছরে দাঁড়াবে প্রায় ১১১ কোটি টাকায়। এ ছাড়া চসিকের আওতায় রয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে ২ হাজার টাকা করে আদায় করলে বছরে আরও ৩০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার রাজস্ব আসতে পারে বর্জ্য খাত থেকে। সব মিলিয়ে বছরে এই খাতের সম্ভাব্য বাণিজ্য দাঁড়াবে ৪১৮ কোটির বেশি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আইন অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে নয়, নির্দিষ্ট স্থানে থেকে বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। নগরবাসীর কাছ থেকে নেওয়া পরিচ্ছন্ন কর নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা অপসারণের জন্য নেওয়া হয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, এটি দলীয় বিবেচনায় নয়, বরং দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজ দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্জ্য সংগ্রহের কাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া বেআইনি পদক্ষেপ। এতে সিটি করপোরেশনের মূল কাজই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি বলেন, এটি অবৈধ ময়লা বাণিজ্যকে বৈধতা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। একদিকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পরিচ্ছন্ন কর আদায় করা হচ্ছে, অন্যদিকে একই কাজের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অতিরিক্ত চার্জ নেওয়া হচ্ছে, যা অসঙ্গতি। বিশেষ করে এই কাজ দলীয় ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে, যা স্পষ্ট দলীয়করণ এবং তা বন্ধ করতে হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!