বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘন করায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। সোমবার (২৮ এপ্রিল) কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মো. ফারজুন ইসলাম বাদী হয়ে খুলনা বিভাগের শ্রম আদালতে এই মামলা দায়ের করেন। বিএটিবির যে চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিশা আব্রাহাম, হেড অফ অপারেশনস জর্জ লুইস মার্সেডো, কোম্পানির সেক্রেটারি ও সিনিয়র লিগ্যাল কাউন্সেল সৈয়দ আফজাল হোসেন এবং প্লান্ট ম্যানেজার (জিএলটিপি) মুকিত আহমেদ চৌধুরী।
এর আগে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মো. মুনছুর বিল্লাল বিএটিবির কুষ্টিয়া কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এতে বিএটিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে সত্যতা পাওয়া যায়। আইন বাস্তবায়নে বিএটিবিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বারবার চিঠি দিলেও তা বিএটিবি বাস্তবায়ন করেনি। ফলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬; বিধিমালাঃ বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর ধারা-৫, বিধি-১৯, ধারা-৪ (১২), ধারা-২৪২ লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে।
অপরদিকে, কুষ্টিয়ায় শতাধিক বিএটিবির শ্রমিক টানা অষ্টম দিনের মতো অবস্থান ধর্মঘট পালন করছেন। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের ২২ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানিতে কর্মরত মৌসুমী শ্রমিক বা কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় তথ্যসহ চাকরিকালীন এক নিয়োগপত্র প্রদান করা হয় না। কর্মরত মৌসুমী শ্রমিক বা কর্মচারীদের প্রতিবছর বছর নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। শ্রমিকদের স্থায়ী করা হয় না। কারখানায় একই সেকশনে একই প্রকৃতির কাজে একজন শ্রমিককে স্থায়ী শ্রমিক (কর্তৃপক্ষের ভাষায় পারমানেন্ট এমপ্লয়ী) হিসেবে কাজ করাচ্ছেন আরেকজন জন শ্রমিককে ২০১২ বা ২০১৩ সালের পরবর্তী সময় হতে বছর বছর কারখানা কর্তৃপক্ষ মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছেন। স্থায়ী পদে নিয়োগকৃত মৌসুমী শ্রমিকদের যোগদানের তারিখ হতে স্থায়ী করা হয়নি। মৌসুমী কারখানায় শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরে নিয়োগকৃত শ্রমিকদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়নি। ২০২৪ সালের মৌসুমে পূর্ববর্তী মৌসুমের ১১ জন মৌসুমী শ্রমিককে চাকুরিতে না নিয়ে ধারা-৪(১২) লঙ্ঘন করেছেন। অংশগ্রহণ তহবিলের ব্যবহার সঠিকভাবে করা হয়নি। কারখানায় কর্মরত মৌসুমী শ্রমিকদের ২০১২ সাল হতে এখনো মুনাফার অংশ প্রদান করা হয়নি।
মামলার নথিতে বলা হয়েছে, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের পর মামলার বাদী ও শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) মো. মুনছুর বিল্লাল বিএটির কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জিএলটি) কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা পান। এ অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় সভা ২০২৪ সালের ৩ জুলাই এই দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ৯ জুলাই কারখানা কর্তৃপক্ষ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিষয়টির আইনগত প্রশ্ন তুলে সৈয়দ আফজাল হোসেন (সিনিয়র লিগাল কাউন্সেল) ও কোম্পানি সেক্রেটারি সই করা একটি চিঠি এই দপ্তরে প্রেরণ করেন। এবং বিষয়টি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে হাজির হননি। বিএটিবি কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জিএলটি) এর কারখানায় কর্মরত ১২৮ জন এবং ২০২৪ সালে নিয়োগ প্রদান না করা ১১ জন এবং চাকরিরত ৫ জনের পক্ষে ২২ দফা দাবি সম্বলিত একটি অভিযোগ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া হয়। যার ভিত্তিতে একটি ত্রিপক্ষীয় সভায় জেলা প্রশাসক তদন্ত করার নির্দেশনা প্রদান করেন। পরে নির্দেশনা মোতাবেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, কুষ্টিয়া এবং আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, কুষ্টিয়ার সমন্বয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি ১৫ সেপ্টেম্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তদন্ত প্রতিবেদন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেন। যার প্রেক্ষিতে পরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) সভাপতিত্বে একটি সভা আয়োজন করা হয়।
সভায় দুইটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে-বিএটিবির কুষ্টিয়া জিএলটি কারখানায় মৌসুমী শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ বরাবর উপমহাপরিদর্শক কার্যালয়, কুষ্টিয়া অবিলম্বে প্রেরণ করবেন। আর বিএটিবি কুষ্টিয়া জিএলটি তদন্ত প্রতিবেদনটি পাওয়ার ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্তের বিষয়সমূহ আইনানুগভাবে প্রতিপালনপূর্বক উপমহাপরিদর্শক কার্যালয়, কুষ্টিয়াকে অবহিত করবেন। বিএটিবির গ্রীন লীফ থ্রেশিং প্ল্যান্টের প্লান্ট ম্যানেজার মুহাম্মদ মাহাবুবুল আলম খান চিঠিতে জানিয়ে দেন, ১০ কর্মদিবসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং আগামী মৌসুম শুরু পর্যন্ত সময় আবেদন করেন। পরবর্তীতে শ্রম পরিদর্শক রাজু বড়ুয়া এই বিষয়ে তাগিদপত্র প্রদান করেন। পরে মুহাম্মদ মাহাবুবুল আলম খান পত্রের মাধ্যমে একটি ব্যাখা প্রদান করেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোন কিছু বাস্তবায়ন করেননি। চলতি বছরের ৪ মার্চ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিএটিবি কুষ্টিয়ার কাছে চিঠিতে ব্যাখা চায়। এই চিঠির জবাবে সৈয়দ আফজাল হোসেনের মাধ্যমে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের মতামত পেশ করেন।
পরে বিএটিবি কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরী (জিএলটি) কর্তৃপক্ষকে আগামী নতুন মৌসুম শুরুর পূর্বেই শ্রমিকদের আইনানুগ দাবিসমূহ প্রতিপালন বা পর্যবেক্ষণসমূহ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী প্রতিপালনপূর্বক তিন কর্মদিবসের মধ্যে অবহিত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে তারা একটি জবাব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় পরবর্তীতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মনিটরিং ও মূল্যায়ন শাখা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলা করার আবেদন করা হয়েছে। বিবাদী বা আসামিরা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩০৭ ও ৩৫২ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ করেছে।