ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড। বহুজাতিক এই সিগারেট কোম্পানির কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে সাতটি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের শ্রম আইন মানা হয় না। কর্মপরিবেশ নেই, কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। একটি ছাড়া বাকি ছয়টি কারখানার অনুমোদন নেই। শ্রমিকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর তদন্ত করেছে সম্প্রতি প্রতিবেদন দিয়েছে। যাতে শ্রম আইন না মানা, কারখানা অনুমোদন না থাকা ও কর্মপরিবেশের সমস্যা রয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে। এই নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনে আজ থাকছে শ্রম আইন না নিয়ে প্রথম পর্ব।
** সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া হয় না, নাইট শিফটের পর ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ইভিনিং শিফট করতে বাধ্য করা হয়
** শাস্তি ও চাকরিচ্যুতিতে আইন মানা হয় না, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি ও মুনাফা শ্রম আইনে অনুযায়ী দেয় না
** দুর্ঘটনা বা পেশাগত ব্যধির কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না, শ্রমিকের নমিনী রাখার ব্যবস্থা নেই
শ্রমিকদের তামাক প্রক্রিয়াকরণের মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকির কাজ করানো হয়। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। দেওয়া হয় না অন্যান্য ছুটি। নাইট শিফটের পর ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ইভিনিং শিফট করতে বাধ্য করা হয়। দেওয়া হয় না এক নিয়োগপত্র। আইডি কার্ডের ইস্যুকারী একজন হলেও নিয়োগকর্তা অন্যজন। শাস্তি বা চাকরিচ্যুতে শ্রম আইন মানা হয় না। শ্রমিক রেজিস্টার নেই। সার্ভিস বুক সংরক্ষণ করা হয় না। দুর্ঘটনা বা পেশাগত জটিল ব্যধি হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। শ্রম আইন অনুযায়ী দেওয়া হয় না প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি ও কোম্পানির অংশগ্রণ তহবিলের মুনাফা। শ্রমিকের নমিনী রাখার ব্যবস্থা নেই। গ্রুপ বিমার আওতায় আনা হয় না। প্রতিবছর টার্মিনেট করা হয়। স্থায়ী শ্রমিকদের কাজ মৌসুমি শ্রমিকদের দিয়ে করানো হলেও শ্রম আইন অনুযায়ী সুবিধা দেওয়া হয় না।
বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটি) বিরুদ্ধে তদন্ত করে শ্রম আইন লঙ্ঘনের এমন ২২টি অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। শুধু শ্রম আইন লঙ্ঘন নয়, বিএটির কুষ্টিয়া মেহেরপুরে সাতটি তামাক প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে ছয়টি কারখানার এই অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নেয়া হয়নি। কারখানায় নেই শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ। কারখানা পরিদর্শন, কাগজপত্র যাচাই ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সম্প্রতি এই সংক্রান্ত পৃথক দুইটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএটি শ্রম আইন না মেনে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে দেশে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নিলে শ্রমিকরা সুবিধা পাবেন।
সূত্রমতে, বিএটির কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরিতে মৌসুমি শ্রমিকদের শ্রম আইন না মেনে হয়রানি, চাকরিচ্যুত, সুবিধা না দেওয়াসহ নানান বিষয় নিয়ে শ্রমিকরা চলতি বছরের আগস্টে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগটি তদন্ত করে সেপ্টেম্বর মাসে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক দুইটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত কমিটি বিএটির কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে সাতটি কারখানা পরিদর্শন ও তদন্ত করেছে। এতে কুষ্টিয়া (জিএলটি) ছাড়া বাকি ছয়টি কারখানা অনুমোদন নেই বলে তথ্য পেয়েছে।
পরিদর্শন পরিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, বিএটির কারখানায় টিএসটি মেকানিক্যাল, টিএসটি ইলেকট্রিক্যাল, কোয়ালিটি, বয়লার নামে শ্রমিকের পদ রয়েছে। যাদের বিএটির ভাষায় ‘পারমানেন্ট এমপ্লয়ি’। ক্যাটাগরি অনুযায়ী, এসব শ্রমিকদের কেউ অফিস ম্যানেজনেমন্টের কাজ করেন। আবার কেউ কারখানার মেশিন মেইনটেন্যান্সের কাজ করেন। তবে এদের কেউ তামাক উৎপাদনের কাজের সঙ্গে জড়িত নন। আবার বশিরুল আলম চাঁদ নামের একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে ‘মেইনটেন্যান্স ক্রু’ হিসেবে মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। যাদেরকে দিয়ে ‘পারমানেন্ট এমপ্লয়ি’ এর মতো মেশিন মেইনটেন্যান্স এর কাজ করানো হয়। আবার এম এস এম লজিস্টিক নামে ঠিকাদারি প্রতিসমান থেকে পুরো বছর কারখানায় কাজ করার জন্য ৫৮ জন মৌসুমি শ্রমিক নেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে—অফিস স্টাফ, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল। অথচ মৌসুমি এসব শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। তামাক মেশিনে দেওয়ার জন্য অর্থাৎ ফিডিং পদে বিএটি সরাসরি কোন জনবল নিয়োগ দেয়নি। এমনকি ঠিকাদারের মাধ্যমেও এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে মেসার্স শিহাব উদ্দিন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেজি প্রতি চুক্তিতে কাজ করাচ্ছে বিএটি। একইভাবে হাউস কিপিং, পিকিং, এসপিএ, ক্লিনিং (বাথরুম, টয়লেট) পদেও কর্তৃপক্ষ সরাসরি বা ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করেনি। তবে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কারখানায় জনবল সরবরাহ না করে সরাসরি কারখানা প্রিমিসেসের ভেতর তামাক প্রক্রিয়াকরণ বা উৎপাদন করছে।
মৌসুমী শ্রমিকদের হয়রানি, চাকরিচ্যুত ও শ্রম আইন না মানার ২২টি অভিযোগের প্রমাণ
আরও বলা হয়েছে, শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া হয় না। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তারা কারখানা গিয়েছেন, সেই দিন ছুটির দিন ছিলো। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এই মৌসুমের শুরু থেকে কাজ করলেও কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পায়নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ যে ‘মান্থলি এটেনডেন্স ডিটেইল’ সংরক্ষণ করেন, সেখানে সাপ্তাহিক ছুটি (রেস্ট ডে) রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই ছুটি শ্রমিকদের দেয় না বিএটি। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করানো হলেও শ্রম আইনের ধারা ১০৪ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণমূলক সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া হয় না। এই ধরনের কোন ডকুমেন্টস কারখানা কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি। শুধু সাপ্তাহিক ছুটি নয়—নৈমিত্তিক ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, উৎসব ছুটিও দেয় না বিএটির কারখানা কর্তৃপক্ষ। নাইট শিফটের পর ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ইভিনিং শিফট করাতে বাধ্য করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। যদিও শ্রম আইনে নাইট শিফটের পর ২৪ ঘণ্টা বিশ্রামের নিয়ম আছে। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নাইট শিফট শেষ হওয়ার পর ১২ ঘণ্টা, ৮ ঘণ্টা—এমনকি কখনো কখনো ১ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্য আরেকটি শিফট করানো হয়। মহিদুল নামে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, তিনি এক টানা ১৬ বছরে চাকরি করছেন। তাকে একটি শিফট শেষ হওয়ার পর কখনো কখনো ১ ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি শিফট করানো হয়। শ্রমিকদের শাস্তি বা চাকরিচ্যুত করতে শ্রম আইন মানা হয় না। চাকরিচ্যুত করা হলেও সব পাওনা পরিশোধ করা হয় না। বরখাস্ত হওয়া ৫ জন শ্রমিককে পাঁচজন শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে সত্যতা পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএটিতে শ্রমিকদের প্রচলিত ও শ্রম আইন অনুযায়ী সুবিধা যেমন—প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি ও মুনাফা প্রদান করা হয় না। যদিও কোম্পানিতে চাকরি শেষে এসব সুবিধা প্রদান করা হয়। তবে একই সালে যোগদান করা, একই কাজে নিয়োজিত, একই পদবীর দুইজন শ্রমিকের মধ্যে একজনকে স্থায়ী করা হয়েছে। আর অন্যজনকে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছে বিএটি। স্থায়ী শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, প্রাচ্যুইটি ও কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিলের মুনাফার সুবিধাভোগী হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী মোট বেতনের ৫০ শতাংশ বেসিক হলেও তা দেয়া হয় না। শ্রম আইনে দূর্ঘটনাজনিত বা পেশাগত ব্যাধির কারণে কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। তামাকের ধূলি কণার কারণে র্দীঘদিন শ্রমিকদের শরীরে প্রবেশ করে সিওপিডির মতো জটিল রোগ হচ্ছে। মৌসুমি শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী নমিনী রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শ্রমিকদের গ্রুপ বিমায় অন্তর্ভূক্ত করা হয় না। মৌসুমি সব শ্রমিককে কলআপ নোটিশ দেওয়া হয় না। মৌসুমি শ্রমিকদের মতামত না নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা কতিপয় শ্রমিক বা ব্যক্তিকে সুযোগ দিয়ে মৌসুমি শ্রমিকদের ইউনিয়নের মাসিক চাঁদা কর্তন বন্ধ করে মৌসুমি শ্রমিকদের ইউনিয়নের সদস্যপদ বিরত রাখার প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করেছে। একইসঙ্গে সিবিএ ইউনিয়নের কতিপয় কর্মকর্তা মালিকের সঙ্গে যোজসাজস করে ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলে চাঁদা প্রদান না করার জন্য প্রতিষ্ঠানের মৌসুমি শ্রমিকদের বাধ্য করেছে। মৌসুমি শ্রমিকরা ২০১৩ ও ২০১৫ সালে শ্রমিক বা কর্মচারী ইউনিয়নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাকি তিনটি নির্বাচনে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ভোট দিতে দেয়নি।
এই বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বিজনেস বার্তাকে বলেন, অবশ্যই আইন মানা উচিত। শুধু শ্রম আইন নয়, আমাদের দেশে ভালো কিছু আইন হয়েছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। শ্রমিকদের অধিকার বা সুরক্ষা—যাই বলেন না কেন, সবার মানা উচিত। আমাদের দেশে গার্মেন্টস খাতে হয়ত বায়ার বা ক্রেতাদের চাপ বা চাহিদার কারণে গার্মেন্টস খাতে শ্রম আইন মানা হয়। কিন্তু সিগারেট কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানি বলে তারা আইন মানবে না, তাতো কাম্য নয়। বরং তাদের আরো বেশি শ্রম আইন মানা উচিত।
এই বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বিএটি বাংলাদেশ এর সঙ্গে বিজনেস বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। পরে একটি পিআর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লিখিত জবাব পাঠায় বিএটি। যাতে বিএটির মুখপাত্রের বরাতে বলা হয়, ‘দেশের সকল আইনানুগ নিয়মনীতি মেনে দীর্ঘ ১১৪ বছর ধরে এই দেশে সুনামের সাথে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিএটি বাংলাদেশ। ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার মানদণ্ড অটুট রেখে বাংলাদেশের আইন মেনে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে বিএটি বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর।’