জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘যারা রিটার্ন দিচ্ছে না, তাদের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হবে। দেশের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও খুবই কম। তাই করহার বাড়ানোর বিকল্প নেই।’ তিনি বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আহরণে আমাদের ওপর চাপ বাড়ছে। রাজস্ব বাড়াতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের যৌক্তিকভাবে কর বাড়াতে হবে। বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, এবার তেমনটি হবে না। সিগনিফিকেন্ট বাজেট হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে নগরের আগ্রাবাদ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে এনবিআরকে আয়কর বিষয়ে ১৯টি, ভ্যাটের ওপর ৪০টি এবং শুল্ক সংক্রান্ত ৫৫টি প্রস্তাব দেওয়া হয়।
চেয়ারম্যান বলেন, কেবল ১৫ লাখ করদাতার অর্থ দিয়ে দেশের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। গত অর্থবছর ৪৫ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করে, যার মধ্যে ৩০ লাখ করদাতা শূন্য রিটার্নধারী। বাকি ১৫ লাখ কারদাতা থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এত কম সংখ্যক লোকের থেকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘যারা রিটার্ন দিচ্ছে না, তাদের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যাংক হিসেব তলব করা হবে। বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও খুবই কম। তাই কর হার বাড়ানোর বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেট হবে ব্যবসাবান্ধব বাজেট। বাজেটকে জনবান্ধব করতে ব্যবসায়ীসহ সকলের মতামত নেওয়া হচ্ছে, যার প্রতিফলন পাওয়া যাবে বাজেটে। আগামী বাজেটে ঘাটতি থাকবে কিন্তু যাতে মূল্যস্ফীতি না হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখা হবে। আর রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে করহারও। মার্কিন শুল্ক আরোপের ফলে দেশের পোশাকখাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ব্যবসায়ীরা যাতে এনবিআর অফিসে ঘুরতে না হয় সেজন্য সবকিছু অটোমেশন করা হচ্ছে। এখন সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে এক লাখ ৬০ হাজার সার্টিফিকেট অনলাইনে প্রদান করা হয়েছে। আয়করের মতো ভ্যাটও যেন ঘরে বসে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে ভ্যাট হার যৌক্তিকীকরণ, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ট্যাক্স রেট কমানো, ট্যাক্সনেট বৃদ্ধি ও রিফান্ড ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হবে।’
মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘প্রশাসনিক জটিলতা সহজীকরণ করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য অটোমেশনে জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি। কোনো কাজ করতে কোথাও যাতে যেতে না হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা। আমি চাই ব্যবসায়ীরা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকবে। অনলাইনেই প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে যাবে। এর ফলে এবার অনলাইনে ১৫ লাখ ৩০ হাজার অনলাইন রিটার্ন পেয়েছি। ব্যবসাবান্ধব করতে এনবিআরকে অটোমেশন করা হচ্ছে।’
ভ্যাট কমানোর প্রস্তাবের জবাবে আবদুর রহমান খান বলেন, আমরা একক হারে ভ্যাট কমাতে প্রস্তুত, তবে সব পণ্যে একই হার হতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও প্রকৃত ভ্যাট প্রদানের ব্যাপারে সৎ হতে হবে। তিনি আরও জানান, এনবিআর প্রতি মাসের পরিবর্তে ত্রৈমাসিক ভ্যাট নিরীক্ষা চালু করার চিন্তা করছে, এবং ভ্যাট ব্যবস্থাকে আরও স্বয়ংক্রিয় করতে কাজ করছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার নিয়েও কঠোর মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য করমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা নেওয়া হলেও তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। স্বর্ণের ক্ষেত্রে তো আমদানি রেকর্ডই নেই, অথচ বাজারে টনকে টন স্বর্ণ পাওয়া যায়।’ রিকন্ডিশন গাড়ির বাজারে আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘১৫ লাখ টাকায় আমদানিকৃত গাড়ি ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে—এটা দেখেই বোঝা যায় আন্ডার-ইনভয়েসিং হয়েছে। এজন্যই ৫০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হচ্ছি।’ জাহাজভাঙা শিল্পে আমদানি শুল্ক নিয়েও সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, দেখতে অযৌক্তিক মনে হলেও, এসব শুল্ক না থাকলে জাহাজগুলোতে মূল ওজনের চেয়ে বেশি তেল আসবে—এটা সুবিধার অপব্যবহারের উদাহরণ।
তিনি বলেন, ‘কর প্রদানে আমরা এরইমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। এখন কর দিতে কোনো ব্যাংকে যেতে হবে না। এর ফলে কমিশন খরচ হবে না। সরকারি কোষাগারে টাকা জমানো হবে সরাসরি। ভ্যাট ও আয়করে অডিট সিলেকশনে ব্যক্তি জড়িত থাকবে না এমন কাজ করছি আমরা। এর ফলে মাঝখানে কেউ প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন, দেশের জন্য কর্মসংস্থান করছেন তারাই রিয়েল হিরো। সরকার ১৫ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছে। বাকি অনেক বড় অংশের চাকরি কিন্তু বেসরকারি খাতে।’
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এবার বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা বেশি। রপ্তানিবান্ধব বাজেট চাই আমরা। আমরা রপ্তানি করে দেশ সমৃদ্ধ করতে চাই, কর্মসংস্থান করতে চাই। এ সময় তারা অন্যান্য দেশের তুলনায় পণ্য রপ্তানিতে বিমান ভাড়া কয়েকগুণ বেশি, বিভিন্ন খাতে এখনও ভ্যাটের পরিমাণ বেশিসহ নানা ব্যাপারে অভিযোগ তথ্য তুলে ধরেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ ও রপ্তানি বাড়াতে গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া দাবিও জানান ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশার সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য রাখেন মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি খলিলুর রহমান, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি সরওয়ার জামাল নিজাম, চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবু তাহের, রাঙামাটি চেম্বারের মামুনুর রশিদ, উইম্যান চেম্বার সভাপতি আবিদা মোস্তফা, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী প্রমুখ।