২ জুন সোমবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট ঘোষণা করবেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে এই বাজেট ঘোষণা করবেন। সংসদ না থাকায় এবার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট পাস হবে। নতুন বাজেটে শুল্ক করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। আমদানি শুল্ক স্তরে যেমন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে, তেমনি সম্পূরক শুল্কেও পরিবর্তন আসছে। অনেক পণ্যে নতুন করে শুল্ক বসতে পারে, আবার কিছু পণ্যে শুল্ক কমানো হতে পারে। আবার স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শুল্ককর কমানো ও বাড়ানোর ফলে পণ্যের দাম বাড়তে ও কমতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পণ্য আমদানিতে, আবার কিছু ক্ষেত্রে পণ্য তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ককর কমানো বাড়ানো হচ্ছে।
শুল্কস্তরের পুনর্বিন্যাস
বর্তমানে আমদানি পর্যায়ে আমদানি শুল্কে ছয়টি স্তর আছে। স্তরগুলো হলো শূন্য, ১ শতাংশ, ৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের ৩ শতাংশ হারে আরেকটি নতুন আমদানি শুল্কহার অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। তবে প্রধান খাদ্যপণ্য, সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ শিল্পের কাঁচামালের বিদ্যমান শুল্ক হার অপরিবর্তিত থাকছে। বর্তমানে আমদানি পর্যায়ে ১২ স্তরের সম্পূরক শুল্ক বসে। এগুলো হলো ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ, ৪৫ শতাংশ, ৬০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ, ২০০ শতাংশ, ২৫০ শতাংশ, ৩০০ শতাংশ, ৩৫০ শতাংশ ও ৫০০ শতাংশ। নতুন বাজেটে ৪০ শতাংশের আরেকটি সম্পূরক শুল্ক স্তর যুক্ত হবে। এ ছাড়া দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসে এমন পণ্যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক অব্যাহত রাখা হবে।
যেসব পণ্যে শুল্ক কমানোর ফলে দাম কমতে পারে
** চিনির আমদানি শুল্ক টন প্রতি ৪৫০০ থেকে কমে ৪০০০ টাকা হতে পারে
** বাস ও মাইক্রোবাস আমদানিতে শুল্ক ২০ থেকে কমে ১০ শতাংশ হতে পারে
** অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ৫ থেকে কমে ১ শতাংশ হতে পারে
** টায়ার, টিউব, ব্রেক সু, ব্রেক প্যাড, মার্বেল ও গ্রানাইটের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির উপর শুল্ক কমতে পারে
** ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাঠ আমদানির উপর শুল্ক কমতে পারে
** সয়াবিন মিল, কাগজশিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমতে পারে
** বাটার বা মাখন আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার হতে পারে
** জাপানিজ সি ফুড স্ক্যালোপ আমদানিতে শুল্ক কমতে পারে
** সুপারি পাতা, নন-অ্যালকোহলিক জুস, ফেনোলিক রেজিন ও স্যান্ডপেপারের কাঁচামালের শুল্ক কমতে পারে
বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক প্রতি টন ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৪ হাজার টাকা করার প্রস্তাব থাকতে পারে। ১৬ থেকে ৪০ আসনের বাস আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ, ১০ থেকে ১৫ আসনের মাইক্রোবাস আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবও বিবেচনায় রয়েছে। ক্রুড ফুয়েল অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে। এবং অন্যান্য জ্বালানি আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমানো হতে পারে। তবে এবার থেকে জ্বালানির ওপর শুল্ক নির্ধারিত হবে ইনভয়েস মূল্যের ভিত্তিতে, ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে নয়। স্থানীয় শিল্প যেমন টায়ার, টিউব, ব্রেক সু, ব্রেক প্যাড, মার্বেল ও গ্রানাইট উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব থাকতে পারে। ক্রিকেট ব্যাট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইংলিশ, কাশ্মীরি ও কোকোনাট উইলো কাঠ আমদানির কর ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হতে পারে।
অপরদিকে, স্থানীয় শিল্প বিকাশে সহায়ক হিসেবে, সয়াবিন মিল, কাগজশিল্পের জন্য কাঁচামালের ওপর শুল্ক হ্রাস এবং চামড়া শিল্পের জন্য কিছু রাসায়নিক উপাদানে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া বাটার বা মাখন আমদানিতে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) প্রত্যাহার এবং নিউট্রালাইজড সয়াবিন তেলের শুল্ক রেয়াতের প্রস্তাব থাকতে পারে। জাপানিজ সি ফুড স্ক্যালোপ আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে। পরিবেশবান্ধব পণ্যের কাঁচামাল যেমন সুপারি পাতার ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ করা হতে পারে। নন-অ্যালকোহলিক জুস আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০০ শতাংশ করার প্রস্তাবও থাকতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় শিরিষ কাগজ শিল্পের প্রয়োজনীয় ফেনোলিক রেজিন ও স্যান্ডপেপার জাতীয় কাঁচামালের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকছে।
আবার পিভিসি পাইপ, কপার ওয়্যার, মোটরশিল্প, ব্যাটারিশিল্প, লিফটম, এলইডি বাতি, রাইস ব্র্যান ওয়েল, টায়ার-টিউব দেশে উৎপাদন করা হয়। পিভিসি পাইপ দেশে উৎপাদন করা হলেও এর উপকরণ আমদানি করতে হয়। এবার উপকরণের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। একই পদক্ষেপ কপার ওয়্যারেও। এই পণ্যের উপকরণ আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কেমিক্যাল পণ্য আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বন্ডের অপব্যবহারও কমবে। বিভিন্ন সফটওয়্যার আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বিদেশি সফটওয়্যারের সঙ্গে দেশি সফটওয়্যারের অসম প্রতিযোগিতা হবে। ইউরোপ, আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে কদর আছে জাপানিজ স্ক্যালোপের। তাই রপ্তানির সম্ভাবনা থাকায় জাপানিজ স্ক্যালোপ আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
শুল্ক বাড়ানোর ফলে যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে
** হেলিকপ্টার আমদানিতে বর্তমানে শুল্ক নেই, নতুন করে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসছে
** বেভারেজ বা পানীয়, এলইডি ল্যাম্প, ওয়াটার পিউরিফয়ার, ফ্যান, সিগারেটের কাগজ
** খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, শিশুদের খাবার, গর্ভবতী নারীদের পুষ্টি উপাদান
** স্যাটিন ফিতা তৈরিতে ব্যবহৃত ওভেন কাপড়
** টেলিভিশনে ব্যবহৃত এলইডি বাল্ব-ওপেন-সেল প্যানেলের শুল্ক বাড়ছে
** লিপস্টিক, আই মেকআপ, ম্যানিকিউর পণ্য, ফেস পাউডার, কসমেটিকস, ফেসওয়াশ, খেলনা
** তামাক বীজ, সয়াবিন মিল, কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাওলিন ক্লে, গ্রানাইট ও মার্বেল
** সিমেন্টের ক্লিংকার আমদানিতের নির্ধারিত শুল্ক বাতিল করে অ্যাড ভ্যালোরেম শুল্ক বসছে
** রেফারেল হাসপাতালের আমদানি করা চিকিৎসা সরঞ্জামের শুল্ক ১০ শতাংশ করা হতে পারে
** কম্পিউটার এক্সেসরিজ আমদানির ওপর চলমান কর রেয়াত বাতিল হচ্ছে, বাড়তে খরচ
** ব্যাটারিচালিত রিকসার মোটর আমদানিতে শুল্ক ১ থেকে বাড়িতে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে
** বিদেশি চকলেট আমদানিতে শুল্ক বাড়তে পারে
স্থানীয় ১৪টি উৎপাদনখাত—যেমন বেভারেজ বা পানীয়, এলইডি বাল্ব, ওয়াটার পিউরিফায়ার, ফ্যান, সিগারেট কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ—এর কাঁচামালে শুল্ক তিনগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রভাবিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য ব্যবহৃত মল্ট এক্সট্র্যাক্ট ও আটা-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের পুষ্টি উপাদান বা সাপ্লিমেন্ট। বেভারেজ কনসেন্ট্রেট আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। সয়া প্রোটিন-ভিত্তিক খাবার ও তামাক শিল্পে ব্যবহৃত সিগারেট পেপারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হতে পারে। স্যাটিন ফিতা তৈরিতে ব্যবহৃত ওভেন কাপড়ের ওপরও একই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। তাছাড়া, ফ্যান উৎপাদনে ব্যবহৃত নন-অ্যালয়ড অ্যালুমিনিয়াম শিট, ওয়াটার পিউরিফায়ারের যন্ত্রাংশ, এবং টেলিভিশন তৈরির জন্য ব্যবহৃত এলইডি বাল্ব ও ওপেন-সেল প্যানেলের ওপরও শুল্ক বাড়তে পারে। এলইডি ল্যাম্পের ওপর শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত সিগারেট পেপারের ওপর শুল্ক হতে পারে ৩৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সরকার লিপস্টিক, আই মেকআপ, ম্যানিকিউর পণ্য, ফেস পাউডার, কসমেটিকস, ফেসওয়াশ, খেলনা এবং বিভিন্ন ধরনের তালা– এসব পণ্যের ন্যূনতম কাস্টমস মূল্যও বাড়াতে পারে, যার ফলে ঘোষিত মূল্যের ওপর ভিত্তি না করে নির্ধারিত মূল্যের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে আমদানিকারকদের।
আরও যেসব পণ্যের ওপর নতুন বা বাড়তি শুল্ক আসতে পারে—তার মধ্যে রয়েছে তামাক বীজ (২৫ শতাংশ), সয়াবিন মিল (৫ শতাংশ) এবং কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাওলিন ক্লে। গ্রানাইট ও মার্বেলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হতে পারে। সিমেন্ট শিল্পে ক্লিংকার আমদানির ওপর নির্ধারিত শুল্ক বাতিল করে ২৫ শতাংশ অ্যাড ভ্যালোরেম শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে, যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। রেফারেল হাসপাতালের জন্য আমদানিকৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। কম্পিউটার এক্সেসরিজ আমদানির ওপর চলমান কর রেয়াত বাতিলের পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে, যার ফলে প্রযুক্তিখাতে খরচ বাড়তে পারে। এসব পরিবর্তন মূলত বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণকে সামনে রেখে শুল্ক কাঠামোর যৌক্তিকীকরণের অংশ, যার লক্ষ্য স্থানীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করে বাণিজ্যে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন। ঢাকা শহরের অন্যতম বিরক্তিকর পরিবহন ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই রিকশার ১২০০ ওয়াটের ডিসি মোটরের কাস্টমস শুল্ক ১ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। চকলেটের দামও বাড়তে পারে। চকলেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ৪ ডলার থাকলেও সেটি বাড়িয়ে ১০ ডলার করার প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা।