মাত্র ছয় মাস আগে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুতকারকদের ওপর করপোরেট কর দ্বিগুণ করার পর, এবার তাদের পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর ফলে প্রচণ্ড গরমের এই সময়ে ভোক্তাদের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনারের উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তবে এনবিআর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। সূত্রমতে, এ দুই খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাটের হার ছিল ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আরো বাড়িয়ে ভ্যাটহার করা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন এই খাতগুলোতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
একইভাবে, মোবাইল ফোন তৈরিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও সাড়ে ৭ শতাংশ হারে যে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাটারি তৈরির ওপরও বিদ্যমান সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা পারে। এ খাতের বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মতো বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ভ্যাট বাড়ানো হলে— বিক্রি আরও কমে যেতে পারে। এবং শেষ পর্যন্ত এর বোঝা ভোক্তাদের ওপরই পড়বে। বর্তমানে এই দুই খাত থেকে সরকার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করে। তবে ভ্যাটহার বাড়লে এই দুই খাত থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হবে।
এনবিআর সূত্রমতে, উৎপাদনশীল খাতকে এগিয়ে নিতে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ফ্রিজ, এসি ও মোটরসাইকেল খাতকে ১২ বছরের জন্য বিশেষ কর সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তখন এই খাতগুলোর জন্য করপোরেট করহার ছিল ৫ শতাংশ। পরে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এসি ও কম্প্রেসর নির্মাতা কোম্পানিগুলোর করপোরেট আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়, যদিও আগে তাদেরকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত কর ছাড় দেয়া হয়েছিল। মাঝপথে এসে নীতি পরিবর্তন করায় বেশ কয়েকটি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় বিষয়টি এখন বিচারাধীন।
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, একসময় এসি খুব বিলাসী পণ্য হলেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এটি এখন প্রয়োজনীয় পণ্য। ফ্রিজও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। তাই এ ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর আগে সরকারের আরো সতর্ক হওয়া উচিত।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী মাসের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টার কাছে এসব প্রস্তুাব তুলে ধরা হবে। তার ও প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের মুখে সরকার কর অব্যাহতি কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, ও এসি’র ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের বিদ্যমান হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট সুবিধার মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হতে যাচ্ছে। এই অব্যাহতির সুবিধা আর না বাড়ানোর বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এসব পণ্যের ভ্যাটের হার স্ট্যান্ডার্ড রেট বা ১৫ শতাংশ হতে পারে। আইএমএফ ভ্যাট এক্সেমশন কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। তাছাড়া এই শিল্পগুলো ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কর সুবিধা পেয়েছে এবং এখন নিজেরাই দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, ২০০৯ সাল থেকে সরকার স্থানীয় শিল্প বিকাশের জন্য ভ্যাট ও কর ছাড় দিয়ে আসছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ফ্রিজ উৎপাদনে কোনো ভ্যাট ছিল না এবং এখনও কম্পোনেন্ট আমদানি ও স্থানীয় পর্যায়ে সংগ্রহে— কিছু ভ্যাট ছাড় অব্যাহত আছে। এধরনের প্রণোদনার সুবাদেই আমূল রূপান্তর এসেছে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারে, যেখানে ৯৫ শতাংশ পণ্যই এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।
ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, গত তিন বছরে ফ্রিজ বিক্রিতে ডিগ্রোথ (নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি) হয়েছে, যদিও এসির বিক্রি প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, চলতি বছর মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন ভ্যাট বাড়ানো হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ— ছাড়াও ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে বলে জানিয়েছেন মেসবাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাটের ভার আসে প্রায় ১০ শতাংশ। উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হলে— ভোক্তার উপর ভ্যাটের বাড়তি প্রেশার আসবে প্রায় ৫ শতাংশ।
অপরদিকে, একটা সময়ে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচিত ফ্রিজ এখন সাধারণ গৃহস্থালী পণ্য হয়ে উঠেছে— বিদ্যুৎ সুবিধা বাড়া, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয়ী মূল্যে দেশীয় পণ্যের উপলদ্ধতার কারণে। বর্তমানে দেশের ফ্রিজ বাজারের আকার ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি, বছরে প্রায় ৩৩–৩৫ লাখ ইউনিট বিক্রি হয় এবং বাজারটি প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, ভিশন ইলেকট্রনিক্স (প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ) এবং সিঙ্গার বাংলাদেশ বাজারে আধিপত্য করছে। অন্যদিকে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসি বিক্রি হয়েছে ৬.২ লাখ ইউনিট, এবং এই বাজারের প্রত্যাশিত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ।
অপরদিকে, একটা সময় পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার পর—গত তিন বছর ধরে মোবাইল হ্যান্ডসেট নির্মাতাদের ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়াচ্ছে এনবিআর। সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ড স্থানীয়ভাবে কমপক্ষে দুটি কম্পোনেন্ট উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ৫ শতাংশ এবং সম্পূর্ণ আমদানিকৃত উপকরণে তৈরি মোবাইলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। উভয় ক্ষেত্রেই এটি আড়াই শতাংশ হারে বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
ট্রান্সসিয়ন বাংলাদেশের সিইও রেজওয়ানুল হক (ট্রান্সসিয়ন হোল্ডিংসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যেটি টেকনো, আইটেল, ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের মালিক) বলেন, বর্তমানে মোবাইল ফোনের গ্রে মার্কেটের আকার প্রায় ৫০ শতাংশ। ভ্যাট বাড়ালে এবং গ্রে মার্কেট নিয়ন্ত্রণ না করলে, বৈধ ও অবৈধ পণ্যের দামের ফারাক আরও বাড়বে, এবং গ্রাহকরা অবৈধ পথে আসা মোবাইল কিনবে। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেট একদিকে ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হবে, অন্যদিকে গ্রে মার্কেটের সাইজ আরো বড় হবে। কেননা দামের গ্যাপের কারনে ক্রেতা ওই পণ্যের দিকে আরো ঝুঁকবে। ২০২৪ সালে প্রায় ৭৯ লাখ স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে। চলতি বছর ভ্যাট বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে বিক্রি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।