অপ্রদর্শিত অর্থ বা কর ফাঁকি রোধে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জমির মূল্য নির্ধারণে আসছে বড় পরিবর্তন। বিদ্যমান মৌজামূল্য পদ্ধতি বাতিল করে জমির প্রকৃত বাজারমূল্যকেই রেজিস্ট্রেশন ও দলিলের ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যেভাবে জমি কেনাবেচা হবে, ঠিক সেই দামে হবে দলিল রেজিস্ট্রেশন। এই মূল্য নির্ধারণে সমন্বয় করবে গণপূর্ত, আইন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রতি বছর জমির এই বাজারমূল্য হালনাগাদ করা হবে এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়মিত একটি ডাটাবেজ প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি, বাজারমূল্য নির্ধারণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রেজিস্ট্রেশন ফি, আয়কর, মূসক ও স্থানীয় সরকারের করের হার কমানো হবে আনুপাতিক হারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে স্থাবর সম্পত্তির হস্তান্তরমূল্যকে বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে। এ লক্ষ্যে একটি খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই খসড়ার ওপর আলোচনা করতে মঙ্গলবার (২০ মে) অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে নীতিমালাটির অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, জমির মূল্য বাজারভিত্তিকভাবে নির্ধারণের উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছিল। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে চারটি বৈঠক করলেও তাতে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত বা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি ২০২০ সালের ২৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে পাঠানো এক চিঠিতে মৌজামূল্য ও প্রকৃত বাজারমূল্যের পার্থক্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে বলে উল্লেখ করে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করেছিল। তবে এসব উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যদি মৌজামূল্য বাতিল করে জমির বাজারমূল্যে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে জমির দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বর্তমানে জমির মূল্য এমনিতেই অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যয় বাড়বে, যা অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণের সুদসহ সার্বিকভাবে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়তে পারেন—এই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, বর্তমানে নিবন্ধন অধিদপ্তর পূর্ববর্তী দুই বছরের জমির নিবন্ধিত মৌজামূল্যের ভিত্তিতে নতুন মৌজামূল্য নির্ধারণ করছে। অধিকাংশ দলিলই মৌজামূল্যে রেজিস্ট্রি হওয়ায় প্রতিবছর এই দরের তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে রাজউক অঞ্চলভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব দিলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম (সিডিএ), খুলনা (কেডিএ), রাজশাহী (আরডিএ), গাজীপুর ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এখনো মৌজাভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্ধারিত মৌজামূল্যকে ভিত্তি ধরে সর্বশেষ ২০২১ সালে নতুনভাবে মূল্য নির্ধারণ করেছে। তবে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কীভাবে জমির মূল্য নির্ধারণ করে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনায় রেজিস্ট্রেশনমূল্য কম হওয়ায় সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, মৌজামূল্যে জমির রেজিস্ট্রেশন হওয়ার কারণে সরকার প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
অর্থ বিভাগের মতে, জমির প্রকৃত বাজারমূল্য গোপন রেখে মৌজামূল্যের ভিত্তিতে লেনদেন হলে বাড়তি অর্থ নগদে আদান-প্রদান হয়, যা শেষ পর্যন্ত হিসাববহির্ভূত বা অপ্রদর্শিত অর্থে পরিণত হয়। এর ফলে কর ফাঁকি দেওয়া সহজ হয় এবং কালোটাকার লেনদেন বাড়ে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে ব্যাহত করছে। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের জমি কম মূল্যে রেজিস্ট্রেশন করানোর সুযোগে ধনী শ্রেণি কর ফাঁকি দিচ্ছে, ফলে দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও তীব্র হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জমি ও সম্পত্তি নিবন্ধন থেকে সরকার বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব আদায় করেছে। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ আদায় হয়েছে ১,৫৯৮ কোটি টাকা, আয়কর বাবদ ৬,৩৯৪ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ ৩৬৮ কোটি টাকা, স্ট্যাম্প ফি বাবদ ৭৭ কোটি টাকা, স্থানীয় কর বাবদ ৩,৯৪৪ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ফি বাবদ আদায় হয়েছে ২৬২ কোটি টাকা।