পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে লিখিত প্রস্তাব চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দপ্তর। তারা জানিয়েছে, প্রস্তাব পাওয়ার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে দর-কষাকষি শুরু হবে। গত ৭ মে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে পাঠানো এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার লিখেছেন এই প্রস্তাবের কথা। এর আগে, গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার আগ্রহ জানিয়ে গ্রিয়ারকে চিঠি দিয়েছিলেন উপদেষ্টা।
৭ এপ্রিল জেমিসন গ্রিয়ারকে দেওয়া চিঠিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্য অর্থাৎ কোনো শুল্ক নেই। বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনের আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে।
উপদেষ্টার পাঠানো চিঠির জবাব হিসেবে জেমিসন গ্রিয়ার এ চিঠি দেন। শনিবার চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি সরকারি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ইউএসটিআরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। খুব শিগগিরই ওই পরিকল্পনা ইউএসটিআরকে জানানো হবে।
গ্রিয়ারের চিঠিতে যা বলা হয়েছে
চিঠির শুরুতে জেমিসন গ্রিয়ার পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের প্রশংসা করে বাণিজ্য উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি উল্লেখ করেন, ইউএসটিআর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। কৃষি ও শিল্প খাতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমিয়ে এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই ঘাটতি কমানো সম্ভব বলে তিনি মত দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংস্কারে বাংলাদেশ যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা স্বাগত জানিয়েছেন ইউএসটিআরের প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। তিনি বলেন, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন ও ডিজিটাল বাণিজ্যে বাধাসহ অন্যান্য অনিয়ম দূর করতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। গ্রিয়ার আরও জানান, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একটি লিখিত প্রস্তাব পেতে আগ্রহী, যাতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা যায়। এর আগে ৭ এপ্রিল পাঠানো এক চিঠিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যে শুল্কহার শূন্য এবং আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উপদেষ্টার চিঠিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে সব রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর গড়ে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ হারে শুল্ক রয়েছে। এর মধ্যে কাঁচা তুলা আমদানিতে শুল্ক নেই। আর লোহার স্ক্র্যাপ আমদানিতে শুল্কহার ১ শতাংশ।
পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পাঁচ দিন পর, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ করেন এবং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশে শুল্ক-সুবিধা দেওয়া হবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসাসামগ্রীসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
দর-কষাকষি চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ৫৭টি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ৩৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তবে ৯ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন, যদিও সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ ন্যূনতম পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়। এ শুল্কের প্রভাব ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ওপর পড়তে শুরু করেছে, এবং অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাড়তি শুল্কের অর্ধেকটা রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কেটে নিচ্ছেন, কিছু ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ পুরোটা নেয়া হচ্ছে।
পাল্টা শুল্ক আরোপের পর চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সহ ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছে। এ আলোচনা এগিয়ে নিতে একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ, এবং এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ইউএসটিআর কী কী বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তা লক্ষ্য করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, ইউএসটিআরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে কী করা হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে আগে চূড়ান্ত করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রকে কী ‘অফার’ দেওয়া হবে এবং দেশটির কাছ থেকে কী চাওয়া হবে। এরপরই আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা উচিত। বাংলাদেশ অতিরিক্ত শুল্ক বাতিল, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কছাড় এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনা শুরুর দাবি করতে পারে।