বিশ্ব বাঁশ দিবস আজ (১৮ সেপ্টেম্বর)। অনেকের চোখে বাঁশ শুধু ঘরদোরের কাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। গ্রামীণ এলাকায় বাঁশের চাষ ও বেচাকেনা হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস হিসেবে কাজ করছে। শহরে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, চেয়ার, টেবিল, খেলনা এবং অন্যান্য শিল্পপণ্য তৈরি হয়ে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশে বাঁশের বাজারের মূল্য ৫০০ কোটি টাকারও বেশি, যা প্রমাণ করে বাঁশ শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম অবলম্বন।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও জেলার যাদুরানী বাজারে প্রতি শুক্রবার সকালে ভিড় জমে যায় বাঁশ কিনতে আসা পাইকার ও খুচরা ক্রেতাদের। এই হাটে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়, বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি টাকা। শুধু যাদুরানী নয়, দেশের অর্ধশতাধিক বড় বাঁশের হাট একইভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। বাঁশের বাজারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য ধরে রেখেছে। রাঙামাটির বন বিভাগের হিসাবে শুধু ওই জেলা থেকে বছরে প্রায় ৭০ কোটি টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। রাজশাহী অঞ্চলে বাঁশ বেচাকেনার বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে মানিকগঞ্জের স্থানীয় হাটগুলোতে মাসে ২৫ লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়, যা বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার সমান।
মৌলভীবাজারের কালারবাজারেও বছরে গড়ে দেড় কোটি টাকার বেশি বাঁশ কেনাবেচা হয়। এই আঞ্চলিক বাজারগুলোর লেনদেন যোগ করলে দেশের বাঁশ অর্থনীতির বার্ষিক মূল্য ৫০০ কোটি টাকার বেশি হয়ে যায়। তবে এখনো এই খাতটি আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানের বাইরে। বাংলাদেশে বাঁশ কেবল নির্মাণসামগ্রী হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না, বরং দৈনন্দিন নানা কাজে অপরিহার্য। গ্রামীণ বাড়ির চালা, বেড়া বা অস্থায়ী সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে ডালি, ঝুড়ি, চালুনি, হাতপাখা, খাটিয়া—সব জায়গাতেই বাঁশের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কৃষিক্ষেত্রে ধান শুকানোর মাচা, ফসল বহনের ঝুড়ি, সবজি চাষে খুঁটি, এমনকি মাছ ধরার চাঁই বা ঝাঁকিও বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের ব্যবহার আরও আধুনিক রূপ নিয়েছে। এখন এটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ফার্নিচার, বাঁশ বোর্ড, বাঁশ কাগজ এবং টেক্সটাইল ফাইবার। পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বাঁশের তৈরি স্ট্র, প্লেট, কাটলারিজ ও টুথব্রাশও দেশ ও বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে বাঁশজাত পণ্য ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার শ্রীবাড়ি রিশিপাড়া এলাকার হস্তশিল্পীরা বাঁশ ও বেতজাত পণ্য তৈরি করে ২৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছেন, যা প্রতিবছর প্রায় এক কোটি টাকার আয় উপার্জন করে। গাজীপুরের কয়েকটি হস্তশিল্প কারখানায়ও মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকার বাঁশজাত পণ্য বিদেশে যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে হস্তশিল্প খাতে ২৯.৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যার বড় অংশই বাঁশ ও বেতজাত তৈরি পণ্য। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের এসব পরিবেশবান্ধব বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা যথেষ্ট।
বিশ্ব বাঁশ দিবসের সূচনা হয় ২০০৯ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বাঁশ বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক বাঁশ ও বেত সংস্থা (আইএনবিএআর) ১৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব বাঁশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিল টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাঁশের অবদানের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে এটি পালিত হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় পর্যায়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়, তবে জাতীয় নীতি নির্ধারণে বাঁশ এখনও প্রান্তিক খাত হিসেবে বিবেচিত। বাস্তবে বাঁশ বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির এক অমূল্য সম্পদ। অর্ধশতাধিক বড় বাজারের লেনদেন মিলিয়ে বার্ষিক আয় ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলে বোঝা যায়, বাঁশ কেবল কৃষক ও কারিগরের জীবিকা নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য শক্তিশালী খাত হিসেবেও গুরুত্ব রাখতে পারে। বিশেষ করে রপ্তানি বাজারে পরিবেশবান্ধব বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ আরও বড় অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বাঁশ চাষ ও বাজারজাতকরণকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনা জরুরি। নির্ভরযোগ্য জাতীয় পরিসংখ্যান তৈরি, কৃষক ও কারিগরদের প্রশিক্ষণ, বাঁশ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ, এবং রপ্তানি সহায়তা বাড়ানো হলে বাঁশ অর্থনীতি বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও বৈদেশিক আয়—দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাঁশের অবদান এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না এবং খাতটির সমস্যা ও সুযোগ সরকারের কাছে পর্যাপ্তভাবে তুলে ধরতে পারছেন না। তিনি বলেন, বাঁশ খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শুধু ঘরদোর বা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্য তৈরির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ইতিমধ্যে বাঁশজাত পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি হচ্ছে, যা এই খাতের আন্তর্জাতিক সক্ষমতাকেই প্রমাণ করছে।