বহুল আলোচিত ভয়ংকর আয়নাঘর দেখল বিশ্ব

একটি ছোট ঘরে ধাতব ইলেকট্রিক চেয়ারে দাঁড়িয়ে ভুক্তভোগীরা তাদের ওপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের বিবরণ দেন। বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটকে রেখে তাদের জবানবন্দি আদায় করা হতো। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তারা কাটিয়েছেন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনে। গত বুধবার সকালে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সেই আলোচিত নির্যাতন কেন্দ্র বা আয়নাঘর পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ভুক্তভোগীদের কয়েকজন তার সঙ্গে যোগ দেন। এছাড়া সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, নবগঠিত গুম কমিশনের সদস্য এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এখানে ‘যারাই নিগৃহীত হয়েছেন, যারা এটার শিকার হয়েছেন, তারাও আমাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মুখ থেকেই শুনলাম কীভাবে এসব হয়েছে। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।বিনা কারণে রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনা হলো, বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী তৈরি করে কোনো একটা ঘটনায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হলো-তুমি সন্ত্রাসী, জঙ্গি ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, এই আয়নাঘর শুধু এখানেই (রাজধানীতে) যে কয়েকটা আছে। কিন্তু আজ শুনলাম এগুলোর বিভিন্ন ভার্সন সারা দেশে আছে। কেউ বলছেন ৭০০, কেউ বলছেন ৮০০ হবে। এর মধ্যে কতগুলো জানা এবং বেশ কতগুলো অজানা।’ রীতিমতো ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ (অন্ধকার যুগ)। গত সরকার যে সেই আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে এটা (গোপন বন্দিশালা) তার একটি নমুনা।

ভুক্তভোগীদের বয়ান :ফেসবুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে পোস্ট দেওয়ায় এক যুবককে আটক করে আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়। তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তার ওপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ২০২০ সালে পোস্ট দেওয়ার পরদিন থেকেই তাকে অনুসরণ করা হয় এবং হাতিরঝিল এলাকা থেকে তুলে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে রাখা হয়। পরে তাকে ঢাকায় একটি গোয়েন্দা কার্যালয়ের টর্চার সেল বা আয়নাঘরে পাঠানো হয়। সেখানে চোখ বাঁধা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হন। আশপাশের শব্দ শোনার চেষ্টা করলে পাশ থেকে চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ পান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বন্দি অবস্থায় বারবার আমার পরিবারের কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে আমার দুটো শিশু সন্তান। এদের একজনের ৭ মাস এবং একজন দেড় বছরের। তাদের কথা খুব বেশি মনে হয়। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম। আমাকে হয়তো এরা শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলবে। পরের দিনগুলোতে আশপাশের বন্দিদের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাদের কেউ তিন বছর এবং কেউ এক বা দেড় বছর ধরে বন্দি থাকার কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ তাকে সান্ত্বনাও দেন।

তিনি বলেন, একটা ১৭ বছরের কিশোর। পাশের কক্ষে সে বন্দি ছিল। রাঙ্গুনিয়া থেকে ধরে আনা হয়। তাকে নিয়মিত পেটানো হতো, যতক্ষণ না তার কান্না থামত। এভাবে ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। পরে সব সময় সে উলঙ্গ থাকত। কিন্তু তার কি অপরাধ তা আমরা আজও জানতে পারিনি।

ড. ইউনূসের সামনে নিজের বন্দিজীবনের হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম আরমান। বিনা বিচারে আট বছরের বেশি সময় বন্দি ছিলেন তিনি। সার্বক্ষণিক হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো, প্রতিদিন চলত ভয়াবহ নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার। একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢোকেন। আরমান জানান, বড় কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে পরিদর্শনে আসতেন, তবে তাদের চেনার সুযোগ ছিল না, শুধু সুগন্ধি ঘ্রাণ পাওয়া যেত। ৫ আগস্ট পরিস্থিতি বদলাতে থাকে, ৬ আগস্ট তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বন্দি জীবনে পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত, কখনো মুক্তি পাবেন সেই আশাও হারিয়ে ফেলেছিলেন।

বুধবার সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত এবং উত্তরা এলাকা পরিদর্শনে যান প্রধান উপদেষ্টা। একে একে র‌্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে থাকা আয়নাঘর পরিদর্শন করেন তিনি। এদিন দুপুরের পর থেকেই আয়নাঘরে প্রধান উপদেষ্টার পরিদর্শনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে শুরু করে।এসব ভিডিওতে দেখা যায়, কচুক্ষেত এলাকার প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে (ডিজিএফআই) একাধিক টর্চার সেল এখন ফাঁকা। বেশ কয়েকটি সেলে নতুন করে রং করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে দেওয়াল। এছাড়া দেওয়ালে বন্দিদের হাতের লেখা, মোবাইল নম্বরসহ বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষা মুছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগারগাঁওয়ে র‌্যাবের বেশ কয়েকটি সেলে জমেছে ধুলোর আস্তর। এখানকার কয়েকটি কক্ষে টাকার বান্ডিল, মদের খালি বোতল এবং বন্দিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সেখানে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের কয়েকজন নিজেদের বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এক কিশোরী তার মাকে দীর্ঘ ৯ বছর বন্দি রাখার কথা জানান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এখনো তিনি তার মাকে খুঁজে ফিরছেন। শেষ পর্যন্ত জীবিত তাকে ফিরে পাবেন কিনা তাও জানেন না। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন।একজন ভুক্তভোগী টর্চার সেলের মেঝেতে বসে দেখান কীভাবে হ্যান্ডকাফ লাগানো অবস্থায় পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হতো। এছাড়া সিলিংয়ে ঝুলিয়ে পেটানোর অভিজ্ঞতা জানান কয়েকজন। কয়েকটি টর্চার সেলের দরজায় একটি ছোট ফুটো দেখা যায়। সেখান দিয়েই বন্দিদের খাবার এবং যোগাযোগের কথা জানান ভুক্তভোগীরা।

পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সাংবাদিকদের আরও বলেন, বন্দিদের ন্যূনতম মানবাধিকারও দেওয়া হয়নি। একেকজনকে খুপরির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। সেখানে বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে। এসব থেকে বের করে না আনা গেলে, সমাজ টিকবে না। এজন্য নতুন করে সমাজ গড়তে হবে। অপরাধীদের বিচারের জন্য এসব প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে।

আয়নাঘর পরিদর্শনকালে ভুক্তভোগী, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ছাড়াও আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সব আয়নাঘর খুঁজে বের করা হবে : দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদন এবং প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আজকের দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ আজকে পতিত স্বৈরাচারের হাতে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আজকে প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সেই কুখ্যাত আয়নাঘর বা টর্চার সেল পরিদর্শন করেছেন।

প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন—দুটি র‌্যাবের এবং একটি ডিজিএফআইর। সেখানে বন্দিদের ওপর হওয়া ভয়াবহ নির্যাতন ও তাদের দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা শুনেন। অনেকে ৭-৮ বছর বন্দি ছিলেন। পুরো ঘটনাটি বিটিভি ভিডিও করেছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। গুম কমিশনের রিপোর্ট ও নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্ত অনুযায়ী, দেশে ৭০০-৮০০ আয়নাঘর ছিল, যা শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছড়িয়ে ছিল।

এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব জানান, আলামত নষ্ট করা হয়েছে কি না, তা গুম কমিশন ও প্রসিকিউটররা তদন্ত করছেন। কিছু জায়গায় নতুন প্লাস্টার করা হয়েছে, কিছু রুমের আকার পরিবর্তন করা হয়েছে, তবে এটি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত তা তদন্তের বিষয়। প্রতিটি আয়নাঘর প্রমাণ হিসেবে সিলগালা করে সংরক্ষণ করা হবে। ব্রিফিংয়ে উপ-প্রেস সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!