বহুজাতিক কোম্পানির নিট মুনাফায় ১৭ % পতন

ভোক্তা চাহিদার পতন, পরিচালন ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে ২০২৫ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত নিট মুনাফা ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ১৪টি বহুজাতিক কোম্পানির মোট নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১,৬০৭ কোটি টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম। গত বছর এ সময়ে মুনাফার পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৯৩৫ কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় এই মুনাফা ৬ শতাংশ বেশি।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে, যা কোম্পানিগুলোর ব্যয় কাঠামোকে চাপের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ ভোক্তারা খরচে সতর্কতা অবলম্বন করছেন, ফলে বিক্রয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

লোকসানে বাটা, সিঙ্গার, আরএকে

চলতি প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য লোকসানের মুখে পড়েছে বাটা শু বাংলাদেশ, সিঙ্গার বাংলাদেশ ও আরএকে সিরামিকস। ডিএসইতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বাটা শু জানিয়েছে, এই প্রান্তিকে তাদের বিক্রি ৩৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ কোটি টাকায়। একই সময়ে কোম্পানিটি ১০ কোটি টাকা লোকসান করেছে, যেখানে গত বছর একই প্রান্তিকে তারা ১৯ কোটি টাকার মুনাফা করেছিল। বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভাঙচুর ও সহিংসতার কারণে কার্যক্রম ব্যাহত হওয়াকে লোকসানের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সিঙ্গার বাংলাদেশ চলতি প্রান্তিকে ৩১ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ২৫ কোটি টাকার মুনাফা করেছিল। কোম্পানিটি জানিয়েছে, বিজ্ঞাপন ব্যয়, ওয়ারেন্টি ক্লেইম, ব্যাংক চার্জ এবং বন্দরে জাহাজ আটকে থাকায় ড্যামারেজ খরচ বেড়ে যাওয়াই লোকসানের মূল কারণ। অন্যদিকে, আরএকে সিরামিকস ১৫ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রান্তিকটিতে ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান করেছে। আগের বছর একই সময়ে তাদের লোকসান ছিল মাত্র এক কোটি টাকা। কোম্পানির মতে, বাজারে নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা হ্রাস পাওয়া এই লোকসানের পেছনে বড় কারণ।

চাপে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) জানিয়েছে, চলতি প্রান্তিকে তাদের নিট মুনাফা ৮১ শতাংশ কমে গেছে। কোম্পানিটির মতে, বিক্রি হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঢাকা কারখানা স্থানান্তরজনিত অতিরিক্ত খরচ এই মুনাফা পতনের মূল কারণ। তবে সব কোম্পানির চিত্র এক নয়—রবি ও মেরিকো চ্যালেঞ্জিং বাজার পরিস্থিতি সত্ত্বেও মুনাফা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

রবি আজিয়াটা চলতি প্রান্তিকে ১৪০ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে। কোম্পানিটির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৫৭ কোটি টাকায়। পরিচালন ব্যয় কমানো, ডিজিটাল কার্যক্রম বিস্তার এবং টাওয়ার শেয়ারিংয়ের মতো উদ্যোগ এই প্রবৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। এদিকে, মেরিকো বাংলাদেশ রাজস্ব ও মুনাফা—দু’দিকেই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ব্যক্তিগত যত্ন পণ্যের স্থিতিশীল চাহিদা ও কার্যকর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ তাদের মুনাফা ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ভোক্তাদের ব্যয় সংকোচনের ফলে ভোক্তাপণ্য কোম্পানিগুলোর বিক্রি কমেছে। পাশাপাশি, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় পরিচালন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে যেসব কোম্পানির পরিচালন দক্ষতা তুলনামূলকভাবে ভালো, তারা কিছুটা স্থিতিশীল থাকতে পেরেছে; তবে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণনির্ভর, তাদের ওপর চাপ আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদদের মতে, উচ্চ সুদের হার ও চলমান মূল্যস্ফীতির প্রভাবে আগামী দিনগুলোতেও এ খাতে মুনাফা অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে—বিশেষ করে নির্মাণসংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর জন্য।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!