বন্দরের দুই কর্মকর্তা বরখাস্ত, শাস্তি পায়নি কাস্টমস কর্মকর্তারা!

বেনপোলে ওজন স্কেলে কারসাজি

যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের ওজন স্কেলে (ওজন পরিমাপক যন্ত্র) ডিজিটাল কারসাজি করে শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই আমদানিকারকদের পণ্য আনার সুযোগ করে দিয়েছিল একটি চক্র। বিষয়টি জেনে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় বেনাপোল কাস্টম হাউস। বন্দর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজস্ব ফাঁকি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের অভিযোগে দুই উপ-পরিচালককে বরখাস্ত করেছ। সোমবার তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে এবং মঙ্গলবার এই নির্দেশনা বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর সই করা চিঠি অনুযায়ী বরখাস্ত করা দুই কর্মকর্তা হলেন-উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মো. মনিরুল ইসলাম ও উপ-পরিচালক (প্লানিং) মো. কবির খান। বরখাস্তের পর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়েছে। তবে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা করা কাস্টমসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বন্দরের এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে অনেক কাস্টমস কর্মকর্তা ঘুষের মোটা অংকের টাকার ভাগ নিয়েছেন। বেনাপোল কাস্টম হাউস কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।

সূত্রমতে, বেনাপোল বন্দরের ডিজিটাল ওয়িং স্কেলে ওজনে কারসাজি করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেদের পকেটস্থ করেছেন এই দুই কর্মকর্তা। রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই আমদানিকারকদের পণ্য আনার সুযোগ করে দেন তারা। মনিরুল ইসলাম ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। এই পরিচয়ে ব্যবহার করেই তিনি প্রধান কার্যালয়ে দাপট দেখাতেন এবং গত ১৪ বছরে লাগামহীন দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ২০২২ সালের ১ অক্টোবর বেনাপোল স্থলবন্দরে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ভারত থেকে আমদানিকৃত পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ওয়িং স্কেলে কারচুপি শুরু করেন মনিরুল ইসলাম। সেসময় ভারত থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ ট্রাক পচনশীল মাছ, ফল, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, টমেটো, আলু ইত্যাদি আমদানি হতো। প্রতিটি চালানে তিন টন করে কম দেখিয়ে ওজন শ্লিপ দেওয়া হতো। সেই অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। বন্দরের কতিপয় কর্মকর্তা ও অসাধু আমদানিকারকদের যোগসাজশে ওজন স্কেলে প্রতিটি ভারতীয় ট্রাকের পণ্যের ওজন কম দেখানো হতো এই দুই কর্মকর্তার নির্দেশে।

সূত্রমতে, প্রতি টন পণ্যের রাজস্ব প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। বন্দরে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হতো এই দুই কর্মকর্তার নির্দেশনায়। ফাঁকি দেওয়া এই রাজস্ব বন্দরের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ নিজেরা ভাগাভাগি করে নিতেন। এভাবে প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হতো। মনিরুল ইসলাম বেনাপোল থেকে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া টাকার একটি অংশ পৌঁছে দিতেন উপ-পরিচালক কবির খানকে। তাদের সেই অপকর্ম প্রকাশ হলে তদন্ত করে স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

স্থলবন্দর সূত্র জানায়, বেনাপোল বন্দরে গতি আনতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্দর অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ ব্যবস্থায় ওজন স্কেলে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের ওজন পরিমাপের পর গাড়ির ওজন বাদ দিয়ে পণ্যের ওজন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি শুল্ক হিসাবের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন হয়। ব্যবস্থাটি চালুর পরপরই কিছু ত্রুটি খুঁজে পায় বন্দর ও কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি চক্র। তারা আগে পণ্য ও ট্রাকের ওজন জেনে যেত। তারা ঘোষণাবহির্ভূত পণ্যের হিসাব লুকাতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিত। কখনো ট্রাকের পেছনের অংশ স্কেলের বাইরে রাখত। কখনো ভারত থেকে আসা ট্রাকের সমপরিমাণ ওজনের আরেকটি ট্রাক স্কেলে রাখত। পরে ঘোষণাপত্রের সঙ্গে মিল রেখে পণ্যের ওজন দেখাত। এভাবে বাড়তি পণ্যের শুল্ক ফাঁকি দিত। কম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েও চক্রটি কারসাজি করত।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!