উত্তরাঞ্চলে যথাযথ সংরক্ষণ ও পরিকল্পনার অভাবে মাঠেই পচে যাচ্ছে হাজার হাজার টন ফসল। বছরে আলু, আম ও সবজি মিলিয়ে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টন ফসল নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য আড়াই হাজার কোটি টাকা। এতে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক, আর লাভ পড়ছে আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উপজেলা পর্যায়ে হিমাগার, প্রি-কুলিং ও আধুনিক সংরক্ষণ অবকাঠামো গড়ে তোলা না হলে কৃষকের এই লোকসান দিন দিন বাড়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর গড়ে ২২ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে মৌসুমে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন আলু পচে যায়। প্রতি কেজি ১৫ টাকা হিসেবে হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০০–৭৫০ কোটি টাকা। আমের ক্ষেত্রেও অবস্থা অনুরূপ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, নওগাঁয় গত মৌসুমে প্রায় ৪.৫ লাখ টন আম ফললেও সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে ১.৩–১.৫ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। প্রতি কেজি ৪০ টাকা ধরে এ ক্ষতি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া রংপুরের হাঁড়িভাঙা এলাকায় আম ফলনের ১০–১৫ শতাংশও নষ্ট হয়ে যায়, যা টাকার হিসেবে প্রায় ৩৬০ কোটি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই অঞ্চলে গড়ে ২৫ শতাংশ সবজি পচে যায় কিংবা কম দামে বিক্রি হয়। প্রতিবছর শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয় পাঁচ থেকে আট লাখ টন। টাকার অঙ্কে সবজির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫০ থেকে ৮০০ কোটি।
কৃষি গবেষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান খান বলেন, আলু, পেঁয়াজ, লিচু ও আম—all দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে কৃষকরা লোকসান ভোগ করছেন, আর আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ফসল মজুদ করে দাম নিয়ন্ত্রণ করে লাভ করছেন। তাই উপজেলা পর্যায়ে ছোট ও মাঝারি হিমাগারের ব্যবস্থা জরুরি।
ক্ষতির মুখে কৃষক
বগুড়া শহরের রাজাবাজারে গত বৃহস্পতিবার সকালে ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছিল কৃষক সেলিম মিয়ার আলুর বস্তা। রাস্তার পাশে বসে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বললেন, হিমাগারে রাখা এখন আর কোনো লাভের কথা নয়। ভাড়া বেশি, জায়গা নেই, আর আলুতে ট্যাক (চারা) উঠতে শুরু করেছে। প্রতি কেজি ৩০ টাকায় হিমাগারে রাখা আলু শেষমেশ ১৫ টাকায় পাইকারদের কাছে দিতে বাধ্য হয়েছি। লোকসান ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ পরিস্থিতি শুধু সেলিম মিয়ার নয়; গোটা উত্তরবঙ্গের হাজারো কৃষকের একই অবস্থা। মৌসুম শেষে সংরক্ষণের স্থান না থাকায় বাজারে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ আলু আসে, ফলে দাম অর্ধেকে নেমে যায়। একই চিত্র পেঁয়াজ, আম ও লিচুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়। উৎপাদনে শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও সংরক্ষণের অভাবে কৃষকরা বারবার লোকসান ভোগ করছেন। কৃষি বিভাগ জানাচ্ছে, আলু, আম ও সবজি নষ্ট হওয়ার মূল কারণ সংরক্ষণ ঘাটতি ও অব্যবস্থা।
রাতদিন পরিশ্রম করার পরও কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ছেন, আর লাভ তুলছেন আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীরা আগাম হিমাগারে আলু বা পেঁয়াজ রাখার বুকিং দিয়ে রাখেন, ফলে সাধারণ কৃষকরা শেষ মুহূর্তে জায়গা পান না। যারা পান, তাদের উচ্চ ভাড়া ও পরিবহন খরচ বহন করতে হয়। এতে কৃষকের লোকসান আরও বেড়ে যায়। মৌসুম শেষে এই আড়তদাররা ধীরে ধীরে বাজারে পণ্য ছাড়েন, দাম নিয়ন্ত্রণ করেন এবং কয়েকগুণ বেশি লাভ তোলেন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
কৃষককে সুরক্ষা দিতে হলে শুধু হিমাগার নয়, পুরো বাজার ব্যবস্থাকেই পুনর্বিন্যাস করতে হবে—এমন মত দিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা। জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের সাবেক সদস্য ড. মো. আলমগীর হোসেন জানান, সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো উপজেলা পর্যায়ে ছোট হিমাগার ও প্রি-কুলিং সুবিধার অভাব। আলু, আম ও সবজির জন্য যদি গ্রেডিং, প্যাকহাউস এবং আধুনিক কোল্ডচেইন ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কৃষক মৌসুম শেষে আর লোকসান ভোগ করবেন না।
এছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্কারও জরুরি। বর্তমানে আড়তদার ও পাইকাররা কোল্ডস্টোরের বড় অংশ আগাম ভাড়া নিয়ে মজুত রাখেন, ফলে তারা ইচ্ছামতো বাজারে পণ্য ছাড়েন এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। এই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছ হিমাগার বরাদ্দ ব্যবস্থা, ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং কৃষক-সহযোগী সমবায় মডেল চালু করা প্রয়োজন।
কৃষি গবেষণা জার্নালের গবেষক হোসেন মো. আলমগীর বলেন, প্রি-কুলিং, গ্রেডিং, প্যাকহাউস ও কোল্ডচেইন না থাকায় উত্তরবঙ্গের বড় অংশের ফসল ঘাম শুকানোর আগেই মাটিতে মিশে যাচ্ছে।
সরকার কী পদক্ষেপ নেবে?
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গে আলু ও আম সংরক্ষণ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে নতুন হিমাগার স্থাপনের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করা হবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ২১০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে করপোরেট ও সমবায় মডেল উভয়ই খোলা রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় কৃষক সংগঠন ও সমবায় সমিতিকে হিমাগার ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যাতে ফসল সংরক্ষণ ও বাজার ছাড়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও রংপুরের আলু, আম ও সবজির পোস্ট-হার্ভেস্ট ক্ষতি ২০-২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০-১২ শতাংশ পর্যন্ত আনা সম্ভব। এতে কৃষকের ক্ষতি কমবে, বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হবে।