বঙ্গবন্ধু কর্নারের নামে শতকোটি টাকা অপচয়

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপন করতে গিয়ে শতকোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। বিশেষ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৮টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২২ কোটি টাকা অপচয় হয় এই কর্নার তৈরিতে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় এই প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলোর মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপন করা হয়েছিল।

গণগ্রন্থাগার ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ তৈরি করে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাতীয় জাদুঘর এই কর্নার তৈরির জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করেনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের বার্ষিক ব্যয় থেকে এই কর্নার স্থাপন করে। বাংলা একাডেমি ৪০০ বই দিয়ে কথিত কর্নারটি তৈরি করেছিল। ড. এনামুল হক ভবনের পাঠাগারের সামনে দ্বিতীয় তলায় তাদের কর্নারটি ছিল। ৫ আগস্টের পর পট পরিবর্তনের কারণে বইগুলো সরিয়ে গুদামে রাখা হয়। জাতীয় জাদুঘরের তৃতীয় তলায়ও এই কর্নারটি ছিল।

জানা গেছে, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ১৮ প্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ জন্য ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) মোছা. মরিয়ম বেগমকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর থেকে তার নেতৃত্বে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আলোচিত অর্থবছরে দেশের ১০৭১টি সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারে এই কর্নার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর বাইরে বিভিন্ন কারাগারের পাঠাগারগুলোতেও এই কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বইয়ের পাশাপাশি এসব পাঠাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যও বানানো হয়। বই সরানোর সঙ্গে সঙ্গে এসব ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়।

সূচনা লগ্নে গ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে সব সরকারি ও বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে ২৫০টি বুক সেলফ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু সরকারি পাঠাগার ছাড়া অন্য কাউকেই কোনো অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়নি। তারা নিজেদের উদ্যোগে নামকাওয়াস্তে কর্নার গড়ে তোলে। জুলাই বিপ্লবের পর ৭১টি সরকারি পাঠাগার থেকে কর্নার উধাও হয়ে যায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যগুলোও ভাঙনের শিকার হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিব কর্নার প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-কর্ম সম্পাদিত বই সরবরাহের মাধ্যমে পাঠক, গবেষক, তথ্য সংগ্রহকারীসহ সর্বসাধারণের কাছে গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে আরও আকর্ষণীয় ও কার্যোপযোগী করে তোলা।’

এদিকে অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শুধু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ই নয়, প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে তোলা হয় এই কর্নার। এমনকি তখন এই কর্নার প্রতিষ্ঠার মহড়া চলছিল। কার আগে কে এই কর্নার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা দৃষ্টি কেড়েছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মূহূর্তে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল শিল্প সংস্থায় রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই কর্নার করা হয়েছে। এ জন্য জাঁকজমক অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়েছিল।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিচ তলায় ক্যান্টিনের পাশে এমন একটি কর্নার গড়ে তোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এসব কর্নার প্রতিষ্ঠায় প্রায় শতকোটি টাকা অপচয় হয়েছে। বলতে গেলে, এই বিপুল অর্থ যেন জলেই চলে গেছে। মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে এসব অর্থ যেন গৌরী সেন দিয়েছেন- এমন মনোভাব ছিল কর্তাদের।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই কর্নার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক উপসচিব মোছা. মরিয়ম বেগম বলেন, ডিপিপি যখন তৈরি হয়, তখন আমি সেখানে ছিলাম না। আমাকে পরবর্তীতে পিডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ডিপিপি অনুযায়ী সবাইকে বইসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ওপরের নির্দেশে তখন আমরা এটি বাস্তবায়ন করেছি। এখন এটি অপচয় হয়েছে কি না- সে বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!