ফরিদপুরে একই নম্বর প্লেটযুক্ত পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তদন্তে উঠে এসেছে ‘পাওয়ার ফাইভ গ্রুপ’ নামের একটি প্রতারণাচক্রের তথ্য। বৈধ ফ্রিল্যান্সিংয়ের আড়ালে তারা অনলাইন জুয়া, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে বিপুল অর্থ। সাবেক এক ক্যাসিনো এজেন্টের দাবি, এই চক্র যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও কম্বোডিয়ায় পাচার করেছে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সম্প্রতি ফরিদপুরে আটক হওয়া গাড়িগুলোতে ছিলেন মোট ২৬ জন, যারা স্থানীয় একটি হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তাদের কয়েকজন একসঙ্গে হোটেলে প্রবেশ করছেন। পুলিশ জানিয়েছে, গাড়িগুলো ‘পাওয়ার ফাইভ গ্রুপ’-এর সদস্যদের। এ গ্রুপের মালিক হলেন মেহেরপুরের শেখপাড়ার মারুফ হোসেন পনির, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের তুলিপ, হবিগঞ্জের মেহেদী, সাভারের হাসিব ও ঢাকার জয়নাল আবেদীন। এর মধ্যে মেহেরপুরের দুজনের হঠাৎ অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠা এলাকায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মাত্র চার বছরে পনির কোটি টাকার ভবন ও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন। তুলিপও কোনো দৃশ্যমান পেশা ছাড়াই বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বৈধ ফ্রিল্যান্সিংয়ের আড়ালে তারা অনলাইন ক্যাসিনো, বাইনান্স অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জুয়া ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ডলার, রুবল, বিটকয়েন ও ইউএস ডলার পাচার করছেন। অভিযোগ রয়েছে, পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের নগদ টাকাও তারা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তর করে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এক অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট বলে, ‘যদি পাওয়ার ফাইভের গুলশান-২ এবং ভাটারা থানার পেছনে আটতলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের সাত তলায় অবস্থিত অফিসের কম্পিউটারগুলো গোয়েন্দারা জব্দ করে তল্লাশি করে, তবে সরকারের লোকজনের চোখ কপালে উঠবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চক্রের কাছে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন আইডি কার্ড। সেগুলো ব্যবহার করে তারা ভুয়া ডিজিটাল মার্কেটিং, ফলোয়ার বাড়ানো ও ভিউ বুস্টিং করে থাকে। প্রতিটি আইডি থেকে গড়ে ৫০ ডলার খরচ করে অনলাইন বেটিং প্রমোশন চালানো হয়। এ ছাড়া বিশেষ টিম গড়ে তারা বেটিং প্ল্যাটফর্মের জন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলে; সফটওয়্যারের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করে। তারা নিজেদের ডেভেলপার ফার্মের মাধ্যমেও বেটিং অ্যাপস চালু করেছে। তাদের নিজস্ব বটভিত্তিক পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম পে কাশমা, পে এটম, সেল্ফ এজেন্ট, টেলিগ্রাম এজেন্ট ও ইনস্ট্যান্ট পে।
এদিকে বিলাসবহুল পাঁচটি গাড়ির মধ্যে দুটির মালিক মেহেরপুরের হওয়ায় জেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—আপন দুই খালাতো ভাই মাত্র চার বছরে কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন? তাদের প্রকৃত আয়ের উৎসই বা কী? যেখানে পনিরের দাদা মেহেরপুর গার্লস স্কুলের সামনে পেয়ারা বিক্রি করতেন আর বাবা খড়ির ব্যবসা করতেন, সেখানে পনির অল্প সময়েই প্রায় ৫ কোটি টাকা খরচ করে শেখপাড়ায় বহুতল ভবন তুলেছেন। ইতোমধ্যে ঢাকার বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন তিনি। শোনা যাচ্ছে, রাজধানীতে তার আরও কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যদিও বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে গাড়াডোব গ্রামের তুলিপের বাবা ভাড়ায় একটি ইটভাটা চালাতেন। তুলিপের কোনো দৃশ্যমান ব্যবসা বা পেশা নেই। তবু হঠাৎ করেই তার বিপুল সম্পদ আর বিলাসবহুল জীবনযাপন স্থানীয়দের বিস্মিত করেছে। বাবাকে উপহার দিয়েছেন একটি টয়োটা এক্স করলা, আর নিজে চালান মার্সিডিস বেঞ্জ ও হ্যারিয়ার। ফরিদপুরে জব্দ হওয়া পাঁচ গাড়ির মধ্যে তুলিপের মালিকানাধীন একটি সিএসআরও রয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে হবিগঞ্জের মেহেদী, সাভারের হাসিব ও ঢাকার জয়নাল আবেদীনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে গাড়ি জব্দের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন মেহেরপুরের মারুফ হোসেন পনির ও তুলিপ। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মেহেরপুরে পনির ও তুলিপের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হতেই কয়েকজন ব্যক্তি তা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। প্রতিবেদকের হাতে তাদের কল রেকর্ডও রয়েছে। এ সময় নৌবাহিনীতে কর্মরত পরিচয় দিয়ে সাবেক জাতীয় বাস্কেটবল দলের একজন খেলোয়াড় ফোন করে তুলিপের ব্যাপারে কোনো খবর প্রকাশের আগে সঠিকভাবে অনুসন্ধান করার অনুরোধ জানান। তার দাবি, তুলিপ কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নন, বরং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
আটক গাড়িগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানতে ফরিদপুর জেলা পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) মো. খুরশীদ আলম শিকদারের সরকারি ফোনে বারবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজেরও উত্তর মেলেনি। এদিকে মেহেরপুরের নবনিযুক্ত পুলিশ সুপার ঢাকায় মিটিংয়ে থাকায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে—ঘটনাটি তাদের জানা আছে, আর তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।