জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শিল্পবান্ধব নীতি ও কর সহায়তা কাজে লাগিয়ে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছেন। এতে দেশে ফ্রিজ, এসি ও টিভির মতো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে উঠেছে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এয়ার কন্ডিশনার তৈরির কারখানায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছেন উদ্যোক্তারা। এর ফলে আনুষঙ্গিক উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশের বড় একটি অংশ এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। তারপরও এসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়েছে এনবিআর।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, এনবিআরের এ সিদ্ধান্তে স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন শিল্পে উদ্যোক্তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। একই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়বে লক্ষাধিক কর্মসংস্থান। এতে সম্পূর্ণ উৎপাদনভিত্তিক দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি শিল্পের টেকসই অগ্রগতি ব্যাহত হবে। উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যেতে পারে। এর ফলে উৎপাদন শিল্পের পরিবর্তে আমদানিনির্ভর সংযোজন শিল্পই বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের ২৭ মে এনবিআর একটি প্রজ্ঞাপন (এস.আর.ও. নং-১৭৬-আইন/২০২৫/৩০৪-মূসক) জারি করে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত না হওয়া রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে। এ নীতিমালাকে সাধুবাদ জানান সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তারা। তবে ২৪ জুনের আগেই ওই প্রজ্ঞাপনের সংশোধনী আনে এনবিআর, যার মাধ্যমে আরেকটি প্রজ্ঞাপন (এস.আর.ও. নং-২৭৪-আইন/২০২৫/৩১৭-মূসক) জারি করা হয়।
সংশোধিত এস.আর.ও-তে (নং-২৭৪-আইন/২০২৫/৩১৭-মূসক) ৮৪ দশমিক ১৮ শিরোনামের অধীনে এইচ.এস কোড ৮৪১৮.৯৯.০০ এর আওতায় রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশকে সম্পূরক শুল্কমুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—যেগুলোর অনেকগুলোই বর্তমানে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে: স্টোপার ব্লক, ডিয়োডোরেন্ট ব্লক, পিপি বটম প্লেট, ক্রিস্পার কভার, ড্রেইনেজ পাইপ কভার, কম্প্রেসার হাউজ কভার, ক্রিস্পার কভার সাপোর্ট, কটন প্যাড ফর শেলফ, রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজার শেলফ, পিপি বেল্ট এবং ডাম্পিং ব্লক। এ ছাড়া ৮৫ দশমিক ৩৬ শিরোনামের অধীনে এইচ.এস কোড ৮৫৩৬.৬১.০০ অনুযায়ী লাইট হোল্ডার আমদানিতেও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ফ্রিজের পাশাপাশি দেশীয় এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন শিল্পের জন্যও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করেছে এনবিআর। শিরোনাম সংখ্যা ৮৪ দশমিক ১৫-এর অধীনে এইচ.এস. কোড ৮৪১৫.৯০.৯০ এর আওতায় এমন বেশ কয়েকটি উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর অনেকগুলোই বর্তমানে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে: ফ্যান ব্লোয়ার, কানেকটিং পাইপ, এক্সিয়াল ফ্যান, ইনডোর ক্যাসিং, এয়ার গাইড প্লেট, টিউব প্লেট, এয়ার ফিল্টার, আইডিইউ প্যানেল, ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ এবং ক্রস ফ্লো ফ্যান।
ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সংশোধিত এস.আর.ও-তে যেসব উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ নতুন করে শুল্কমুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই বর্তমানে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করছে। অথচ পূর্বের এস.আর.ও-তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, শুধু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই আমদানিতে শুল্ক ছাড় পাবে—সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নয়। ফলে সংশোধনের মাধ্যমে আগের শর্তাবলি উপেক্ষা করে দেশীয় শিল্পের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশীয় ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তারা প্রশ্ন তুলেছেন, যখন দেশে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ ও প্ল্যান্ট স্থাপন করে আমদানি বিকল্প খুচরা যন্ত্রাংশ ও উপকরণ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, তখন কেন এবং কার স্বার্থে এসব পণ্যের আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হলো? তাদের প্রশ্ন, এই শুল্কনীতি আসলে দেশীয় উৎপাদনশীল শিল্পের কতটা সহায়ক? এ সিদ্ধান্তে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি কি আরও বাড়বে না? আর তাতে কি উৎপাদনের আড়ালে সংযোজননির্ভর শিল্প গড়ে ওঠার আশঙ্কা নেই? এই প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে উদ্যোক্তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে দাবি জানাচ্ছেন—যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যেন বাতিল করা হয়।