জালিয়াতি করে ইপিএস বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে

ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড

ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেডের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে একাধিক অনিয়ম ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনে কোম্পানির স্থায়ী সম্পদ ৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দেখানো হলেও, এর কোনো বিস্তারিত তালিকা (ফিক্সড অ্যাসেট রেজিস্টার) নেই। এছাড়া মজুত পণ্যের হিসাবেও রয়েছে অসংগতি। কাঁচামাল কেনার আড়ালে অর্থ সরানোর প্রমাণও মিলেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে কোম্পানির আর্থিক হিসাবে একাধিক তথ্যের গরমিল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অভিযোগ উঠেছে, বিনিয়োগকারীদের ঠকাতে নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি। এ কারণে ঠিকঠাক মুনাফা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ, ২০২০ সালে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও এরপর দুই বছর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানি। ২০২৩ সালে নামমাত্র দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি ৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। মুনাফার একটি অংশ কোম্পানিতে রেখে দেওয়া হয়। একে বলা হয় রিটেইন্ড আর্নিংস। কোনো বছর কোম্পানি লোকসান করলে রিটেইন্ড আর্নিংসে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেয় কোম্পানি। নিরীক্ষক জানিয়েছেন, ফু-ওয়াং ফুডসের আর্থিক হিসাবে ১০৭ কোটি ২২ লাখ টাকার ঋণাত্মক রিটেইন্ড আর্নিংস রয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানির কোনো মুনাফা জমা নেই, ঘাটতিতে চলছে।

অন্যদিকে রিটেইন্ড আর্নিংসে দেখানো অর্থের মধ্যে ৯৯ লাখ টাকার লোকসান আয়-ব্যয়ের অংশে (ইনকাম স্টেটমেন্ট) দেখানোর পরিবর্তে রিটেইন্ড আর্নিংসে সমন্বয় করা হয়েছিল। এই লোকসান যদি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইনকাম স্টেটমেন্টে দেখানো হতো, তাহলে শেয়ারপ্রতি মুনাফা বা ইপিএস কমত ৯ পয়সা। এর মানে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ লোকসান গোপন করে ইপিএস বাড়িয়ে দেখিয়েছে।

বিষয়টিকে ‘বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, যেসব কোম্পানির আর্থিক হিসাবে এ রকম নয়ছয় রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যাতে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসে।ফু-ওয়াং ফুডস একসময় ভালো ব্যবসা ও মুনাফা করা একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন সেটি লোকসানে চলছে। তিন বছর ধরে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।

নিরীক্ষক জানিয়েছেন, কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে ৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে। তবে ওই সম্পদের রেজিস্টার না থাকায় সত্যতা যাচাই করা যায়নি। এ ছাড়া হিসাব মান অনুযায়ী, ৩-৫ বছর অন্তর সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হলেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের পর আর করেনি।ফু-ওয়াং ফুডস কর্তৃপক্ষ আর্থিক প্রতিবেদনে ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকার মজুত পণ্য দেখিয়েছে। তবে কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শনে অসংগতি পেয়েছেন নিরীক্ষক। বিশেষ করে ৩৪০ আইটেমের মধ্যে ১০৪টির কাঁচামাল, বিক্রিযোগ্য পণ্য ও প্যাকিং জিনিসের ক্ষেত্রে অসংগতি পেয়েছেন।

কাঁচামাল কেনার জন্য অগ্রিম ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ফু-ওয়াং ফুডস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকাই আগের বছরের। নিরীক্ষককে এই অর্থের বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট) সঠিক জবাব দিতে পারেনি। এমনকি কাঁচামাল সরবরাহকারীদের তালিকাও নেই। ফলে ওই অগ্রিম প্রদান করা অর্থের বিষয়টি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।

আর্থিক হিসাবে কাঁচামাল সরবরাহকারীরা ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নিরীক্ষক এ বিষয়ে সত্যতা যাচাইয়ে পাওনাদারদের চিঠি দিলেও ২৭ জনের মধ্যে ১১ জনের পাওনার বিষয়ে সত্যতা পেয়েছে। আর কোম্পানির হিসাবের সঙ্গে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকার অসংগতি পেয়েছে।এসব বিষয়ে জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিয়া মামুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। কোম্পানির সচিব মোহাম্মদ জামানকে অনেকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেনি।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি বাড়ানো ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করছে বিএসইসি। কোনো কোম্পানির আর্থিক হিসাবে কারচুপি বা অসংগতি পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কমিশন। ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ফু-ওয়াং ফুডের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১১০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালক ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের মালিকানায় রয়েছে ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ শেয়ার। সোমবার ( ৭ এপ্রিল ) কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ২০ পয়সা কমে ১৬ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়।

** ১০ বছর পরও ভ্যাট ফাঁকি মাফ পাচ্ছে না ‘ফু-ওয়াং’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!