** মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের মধ্যে নতুন শর্ত নিয়ে হতাশা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে
** অর্থ মন্ত্রণালয় ভুল করেছে, এনবিআর থেকে বারবার বলা হলেও আমলে নেয়া হয়নি
** ভুল সংশোধন না করলে এনবিআর থেকে চিঠি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা
কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগে ৩০ বছর বয়সে একজন সিপাহি যোগদান করেছেন। পুরোনো অরগানোগ্রাম অনুযায়ী, ১০ বছর ফিডার পদ পূর্ণ হলেই অর্থাৎ তার বয়স ৪০ বছর হলেই তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) হতে পারবেন। কিন্তু নতুন অরগানোগ্রামে সিপাহি পদের ফিডার পদ করা হয়েছে ১৬ বছর। অর্থাৎ চাকরির যোগদানের ৪৬ বছর পর এই সিপাহির ফিডার পদ পূর্ণ হবে বা তিনি পদোন্নতির যোগ্য হবেন। ফিডার পদ পূর্ণ হলেই যে পদোন্নতি পাবেন, তা কিন্তু নয়। ফাইল প্রসেসিং, পদ শূন্য থাকা, পদোন্নতি জটিলতা—সব মিলিয়ে ৫০ বছর বয়সে গিয়ে তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হবেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ায় রয়েছে আরও জটিলতা। স্থায়ী হতে পাঁচ-সাত বছর কেটে যাবে। অর্থাৎ চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই এই কর্মকর্তার চাকরি থেকে অবসরের সময় হয়ে যাবে। মানে তিনি স্থায়ী না হলে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাবেন না। পাবেন না কোনো সুযোগ-সুবিধা।
শুধু সিপাহি নয়, কাস্টমস ও ভ্যাটের মাঠপর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সব কর্মচারীরই একই গল্প। যেখানে পুরোনো অরগানোগ্রামে পদোন্নতি জটিলতাই দূর হয় না, সেখানে নতুন অরগানোগ্রামে পদোন্নতিতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পদোন্নতির সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা এই শর্ত দ্রুত বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন।
এনবিআর সূত্রমতে, নবসৃষ্ট ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউসগুলোর অরগানোগ্রাম (সাংগঠনিক কাঠামো) চূড়ান্ত করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। ১২ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় অরগানোগ্রাম চূড়ান্ত করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পাঠিয়েছে। তবে এসব দপ্তরে কর্মচারী পদায়নের ক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি ও নতুন নিয়োগ দেয়া হবে। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে শর্ত রাখা হয়েছে, তা নিয়ে সারাদেশে কর্মরত উচ্চমান সহকারী, সাঁটলিপিকার, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক ও সিপাহি পদমর্যাদার কর্মচারীদের মাঝে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এসব পদে এনবিআরে মাঠ পর্যায়ের সব অফিসে তিন হাজারের বেশি কর্মচারী কাজ করছেন। নতুন অরগানোগ্রাম অনুযায়ী, তিন ধাপে নবসৃষ্ট ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউসগুলোয় তিন হাজার ৫৯৭টি (প্রথম পর্যায়ে তিন হাজার ৬৬টি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩৮টি এবং তৃতীয় পর্যায়ে ২৯৩টি) পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। নবম গ্রেড (প্রথম শ্রেণি) তদূর্ধ্ব পদ সরকারি চাকরি (কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ) নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী পূরণ করা হবে। বাকি পদগুলোয় বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে।
সূত্রমতে, ক্যাডারবহির্ভূত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা (শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট) নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি আইনে বলা আছে, দ্বিতীয় শ্রেণির সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে শূন্য পদের বিপরীতে ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ ও ৫০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে কর্মরত অফিস সুপারিনটেনডেন্ট, প্রধান সহকারী, সাঁটলিপিকার, উচ্চমান সহকারী, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক, কম্পিউটার অপারেটর, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, পরিসংখ্যান অনুসন্ধায়ক, ক্যাশিয়ার পদে পাঁচ বছর; অফিস সহকারী, নকশাবিদ, পাঞ্চকার্ড অপারেটর, পেশকার ও রেকর্ড কিপার পদে সাত বছর; সাব-ইন্সপেক্টর পদে চার বছর অথবা সিপাহি পদে ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা লাগবে। একই সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রিসহ বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
অপরদিকে, নতুন অরগানোগ্রামে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগের পাশাপাশি তৃতীয় শ্রেণির পদ থেকে পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে। অরগানোগ্রামে উল্লেখ করা হয়েছে—সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১২তম গ্রেডের (কম্পিউটার অপারেটর, সাঁটলিপিকার) কর্মচারীদের ছয় বছরের, ১৩-১৪তম গ্রেডের (উচ্চমান সহকারী ও সাঁটলিপিকার) কর্মচারীদের আট বছরের, ১৫-১৬তম বেতন গ্রেডের (গাড়িচালক) কর্মচারীদের এবং ১৭-১৮তম বেতন গ্রেডের (সিপাহি) কর্মচারীদের ১৬ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা লাগবে। অর্থাৎ নতুন অরগানোগ্রামে প্রতি পদে চাকরির অভিজ্ঞতার সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই নতুন শর্তারোপ নিয়ে মাঠপর্যায়ে এসব পদে কর্মরতদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মচারী অসন্তোষ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, পদোন্নতির এই শর্তে বাড়ছে ডিপার্টমেন্টাল অসন্তোষ। বড়রা বড় হচ্ছে, ছোটরা আরও ছোট। একজন কর্মচারী ৩২ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদানের পর ১৬ বছর চাকরি করার পর পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করবেন। পদোন্নতি প্রসেসিংয়ে চার-পাঁচ বছর লেগে যায়। দুই বছর অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য তাকে বেঁচে থাকতে হবে আরও ৫৭ বছর।
কর্মচারীরা জানিয়েছেন, বিধিমালায় বলা আছে, কোনো কর্মচারী যে বিধিমালায় যোগদান করবেন, তিনি সেই বিধিমালা অনুযায়ী পদোন্নতিসহ সব ধরনের সুবিধা পাবেন। কিন্তু নতুন অরগানোগ্রাম নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ধোঁয়াশা ও হতাশা তৈরি হয়েছে। একাধিক আইনজীবীর মতে, এই অরগানোগ্রাম পাস হলে, বর্তমানে পদোন্নতিযোগ্য সব কর্মচারীকে নতুন অরগানোগ্রাম অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হবে। কারণ নতুন অরগানোগ্রাম পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের অর্থাৎ ২০১০ সালের বিধিমালা রহিত হয়ে যাবে। কর্মচারীরা জানিয়েছেন, মাঠপর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বহু পদোন্নতিযোগ্য কর্মচারী রয়েছেন, যার মধ্যে অনেকেই বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করেছেন, অনেকেই পরীক্ষা দেবেন, অনেকের সহসাই ফিডার পদ পূর্ণ হবে। পুরোনো অরগানোগ্রাম রহিত হলে গেলে এসব পদোন্নতিযোগ্য কর্মচারী পদোন্নতিবঞ্চিত হবেন বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এনবিআর থেকে উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানান তারা।
একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর তৃতীয় ও শ্রেণির নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বেশিরভাগ স্নাতক পাস। অনেকেই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি হলেও অনেকেই কাস্টমস ও ভ্যাট দপ্তরে রয়ে গেছেন। কারণ সময়মতো চাকরি স্থায়ী, ফিডার পদ পূর্ণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া যায়। কিন্তু নতুন অরগানোগ্রামে পদোন্নতি শর্ত জুড়ে দেয়ায় তারা হতাশায় ভুগছেন।
কর্মচারীদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ২০২২ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভ্যাট-কাস্টমস সম্প্রসারণের অনুমোদন দেয়। তার আলোকে চলতি বছরের ৮ জুলাই রাজস্ব খাতে সাড়ে তিন হাজার পদ সৃষ্টির অনুমোদন দেয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভুলের কারণে এমন হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি, বলেছি এটা আপনাদের ভুল হয়েছে। আমাদের কথা তারা আমলেই নেয়নি। দেখি তারা কী করেন। না হলে আমরা অফিশিয়ালি তাদের চিঠি দেবো। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। আমাদের বোঝানো দরকার। আমরা ডকুমেন্টসহ তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসছি। সংশোধন করার কথা তাদের অনেকে বলেছেন। না করলে শিগগিরই আমরা চিঠি দেবো। এই কর্মকর্তার মতে, এটা তো হতে পারে না। একটা কর্মচারী ১৭তম গ্রেডে আছেন। তাকে ১০ বছর থেকে ১৬ বছরে পদোন্নতি, তা তো হতে পারে না।