ফরচুন সুজের কারসাজি: টাকার পাহাড় গড়লো কারা?

যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে, তার বন্ধু ইলন মাস্কের টেসলা কোম্পানির শেয়ারের দাম এক দিনে ১৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এ ঘটনায় পশ্চিমা মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার ঝড় ওঠে। অথচ ২০২১ সালে বাংলাদেশের ফরচুন সুজ কোম্পানির শেয়ারদর আট মাসে ৪০০ শতাংশ বেড়ে গেলেও কোনো আলোচনা হয়নি।

ফরচুন সুজের শেয়ারদর উল্লম্ফনের মূল কারিগর ছিলেন আবুল খায়ের হিরু। তার কারসাজিতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে—দুবাইতে ব্যবসা খুলেছে, বিদেশে গড়ে তুলেছে আলিশান বাড়ি। কিন্তু এই কারসাজির কারণে লাখো সাধারণ বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। একসময় ১৫০ টাকায় যাওয়া ফরচুন সুজের শেয়ার এখন নেমে এসেছে মাত্র ১৫ টাকায়। বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলছেন—বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), গোয়েন্দা সংস্থা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নজরদারি এড়িয়ে সরকারি কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু কীভাবে এত বড় কারসাজি করলেন? তাহলে কি হিরু ইলন মাস্কের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে গিয়েছিলেন?

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালে মাত্র ছয় মাসে ৪৮৩ শতাংশ শেয়ারদর বাড়ে ফরচুন সুজের। ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল মাত্র ১৮ টাকা। একই বছরের ২১ অক্টোবর সেই দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫ টাকায়। তাতে ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ে প্রায় ছয়গুণ। কারসাজির আগে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত এ ফরচুন সুজের শেয়ারদর ৩০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে। ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজিতে হিরুর পাশাপাশি জড়িত ছিল ফরচুন সুজের মালিকপক্ষ। বিএসইসির তদন্তে এটি উঠে এসেছে। হিরুর সহযোগী বেশকিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ফরচুন সুজে বিনিয়োগ করে লাভ নিয়ে সময়মতো কেটে পড়ে বলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নামমাত্র জরিমানা ছাড়া কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বিএইসি সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কের কারণে ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন বিএসইসি ফরচুন সুজ লিমিটেডের অনিয়ম, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে শেয়ার কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশের অর্থ না দেয়াসহ কোম্পানিটির শেয়ারের দর বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিএসইসির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মূলত এর আগের চেয়ারম্যানের সময়ে আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীরা পুঁজিবাজারে কারসাজি করেছে বলে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে বিএসইসি। সেই তদন্তের ভিত্তিতেই এখন বিএসইসির পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর আগেও, ফরচুনের শেয়ার জালিয়াতির দায়ে হিরু ও তার পরিবারের কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছিল। অন্যদিকে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে তথ্য চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিএসইসিতে চিঠি পাঠিয়েছে।

বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজির বিষয়টি আগের কমিশনের সময়ে তদন্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি এখনই কিছু জানাতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে তবেই বিস্তারিত জানাতে পারব।’

আবুল খায়ের হিরুর বক্তব্য জানতে কয়েক দফায় হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। আবুল খায়ের হিরু বলেন, ‘আমি বিনিয়োগকারী, মুনাফা করার জন্যই পুঁজিবাজারে এসেছি। ফরচুন সুজের পক্ষ থেকে ইতিবাচক তথ্য প্রকাশ হলে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ করেছি। কানো মিথ্যা তথ্য দেয়া হলে তার দায় আমার নয়। আর সাকিব আমার ব্যবসায়িক সহযোগী। আমরা নিয়ম মেনেই ব্যবসায়ী করেছি। ফরচুনের দাম কমে যাওয়ার কারণে আমরাও ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছি। কোম্পানিটি দাম বাড়ার আগে ভালো ভালো তথ্য দিলেও এখন মুনাফা কমেছে। এখন বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও দিতে পারছে না।’

জানা গেছে, ফরচুন সুজের জুতার ব্যবসায় বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু কোম্পানির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান টাকার লোভে ২০২১ সালে হিরুর সঙ্গে জড়িয়ে যান। পাশাপাশি দ্রুত সখ্য হয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও। তারপর চতুর হিরুর সঙ্গে কারসাজির ছক চূড়ান্ত করেন মিজানুর রহমান, হিরুর কথামতোই নতুন নতুন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দিয়ে ফরচুন সুজকে পুঁজিবাজারের আকর্ষণীয় শেয়ারে পরিণত করা হয়। তখন ফরচুন সুজ মানেই ছিল দরবৃদ্ধি, মুনাফা আর চমক। আর এই চমকেই ফেঁসে গেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে ১০ টাকা করে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। শুরুতে দর ভালো থাকলেও একপর্যায়ে কোম্পানিটির দর ২০ টাকায় নেমে আসে। তখনই নজর পড়ে পুঁজিবাজারের আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের হিরুর। হিরুর স্পর্শে প্রতিটি শেয়ারের দর সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ওপরে উঠে যায়। এরপরে পুঁজিবাজারে কারসাজির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় কোম্পানিটি। হিরুর সঙ্গে তৎকালীন বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি বর্তমানে কারান্তরীণ শিবলী-রুবাইয়াত উল ইসলামের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। যে কারণে তিনি হিরু ও তার সহযোগীদের কারসাজি বন্ধে বিএসইসির চেয়ারম্যানের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন ফরচুনের পোর্টফলিওতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে জেনেক্স ইনফোসিসে ৫০ হাজার, আইপিডিসিতে চার কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও সোনালি পেপারে ২৮ কোটি পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। ২০২৩ সালের ৩০ জুন থেকে হিরু চক্রের সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে আইপিডিসি ও সোনালী পেপারে বড় বিনিয়োগ ছিল ফরচুন সুজের। ওই সময় ফরচুন সুজের পুঁজিবাজারে ৩৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। এর মধ্যে আইপিডিসিতে ৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ও সোনালী পেপারে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল।

জানা গেছে, ফরচুন সুজের মালিক বরিশালের অধিবাসী মিজানুর রহমান। তিনি সাকিব আল হাসান, আবুল খায়ের হিরু ও জেনেক্স ইনফোসিসের চক্র সম্মিলিতভাবে শেয়ার কারসাজি করেন। কারসাজি করে মাত্র ছয় মাসে মিজানুর রহমান মুনাফা করেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তারপর তিনি ঢাকার ব্যবসায়ী, মিডিয়া ও স্পোর্টস এলিটদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফরচুন বরিশাল’ দলের মালিকানা নেয়ার পর সম্পর্ক আরও পাকাপোক্ত হয়। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিপিএল ক্রিকেটে ফরচুন বরিশাল দলের নেতৃত্ব দিতে কারসাজির সহযোগী সাকিব আল হাসানকেও দলে নেন মিজানুর রহমান। ক্রিকেটার সাকিবের ব্যবসায়িক পার্টনার আবুল খায়ের হিরু, অন্যদিকে বিপিএলে ফরচুন বরিশালের বড় বিজ্ঞাপনদাতা জেনেক্স ইনফোসিস।

যদিও আবুল খায়ের হিরুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফরচুন সুজের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। শেয়ার কারসাজির অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সেই তথ্যই প্রকাশ করেছি যেগুলো সত্য। অতিরঞ্জিত কোনো তথ্য আমরা দিইনি। আবুল খায়ের হিরু বা অন্য কোনো সিন্ডিকেট গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম বাড়ালে তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগসাজশ নেই। কিন্তু আমাদের জড়িয়ে অনেক ধরনের মিথ্যা প্রচারণা করা হয়েছে, যেগুলোর সত্য নয়।’

কোম্পানির পক্ষ থেকে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হলেও এখন ফরচুন সুজের আয় ও মুনাফায় তার কোনো প্রতিফলন নেই। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ফরচুন সুজের কর-পরবর্তী মুনাফা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র আট কোটি ৪৪ লাখ টাকায়।

২০২০ সালে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এরপর ২০২১ সালে মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় এবং ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা। তবে এরপর থেকে ফরচুন সুজের মুনাফা ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে। মুনাফা কমার কারণে কোম্পানিটির শেয়ারের দামও পড়তে শুরু করে। গতকাল ফরচুন সুজের প্রতিটি শেয়ার ১৫ টাকা ৯০ পয়সায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!