** ৯টি প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিবিড় তদারকি করতে বন্ড কমিশনারেটকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, রাজস্ব ফাঁকি প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা
** বন্ড লাইসেন্সে অনুমোদিত বিভিন্ন কাঁচামালের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্য অধিক পরিমাণে আমদানি হচ্ছে
** পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার, পিইউ লেদার, পিভিসি লেদার, পলিস্টার টাফেটা ফেব্রিকস, প্রিন্টিং পিভিসি শিট, পলিয়েস্টার ইন্টারলাইনিং, পিভিসি কোটেড টেক্সটাইল ফেব্রিকস আমদানি হয়ে সরাসরি যাচ্ছে খোলাবাজারে
** কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধান অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ৯টি প্রতিষ্ঠান হলো-তুয়ান প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ; তাম্মি এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ; রেডিয়ান এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ; হোলি ইলাস্টিক লিমিটেড; তাকওয়া ট্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ; মিরহা এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড; উজ্জ্বল ফ্রেবিকস লিমিটেড; ওমর গার্মেন্টস এক্সেসরিজ; ডংহু বিডি লিমিটেড
এক্সেসরিজ খাতের প্রতিষ্ঠান। বন্ড লাইসেন্সে বেশ কিছু কাঁচামালের অনুমোদন রয়েছে। প্রাপ্যতাও নেয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি কাঁচামাল অধিক পরিমাণে আমদানি হচ্ছে, যেমন পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার, পিইউ লেদার, পিভিসি লেদার, পলিয়েস্টার টাফেটা ফেব্রিকস, প্রিন্টিং পিভিসি শিট, পলিয়েস্টার ইন্টারলাইনিং, পিভিসি কোটেড টেক্সটাইল ফেব্রিকস প্রভৃতি। আবার এসব কাঁচামাল খোলাবাজারে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে। অথচ বন্ড সুবিধা ছাড়া এসব কাঁচামাল খুব বেশি আমদানি হয় না, যার অর্থ দাঁড়ায় বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল পণ্য তৈরি করে রপ্তানির কাজে নয়, চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, প্রাপ্যতার সঠিকতা যাচাইয়ের দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে অসাধু বন্ড প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি অ্যাকসেসরিজ খাতের বন্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্যতা ও খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রির অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই খাতের বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়টি সামনে আসে। অ্যাকসেসরিজ খাতের ৯টি প্রতিষ্ঠানের আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে বেশ গরমিল পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। ব্যবস্থা নিতে বন্ড কমিশনারেটকে কাস্টমস গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব কাঁচামালের খোলাবাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে খোলাবাজারে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা এক্সেসরিজ খাতে এসব কাঁচামাল সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে-এমন ৯টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামালের তথ্য যাচাই করেছে। কাঁচামালের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম পাওয়া গেছে। আমদানি করা এসব কাঁচামাল সঠিকভাবে ব্যবহার না করে থাকলে সরকারের প্রায় ১৬৪ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে বলে ধারণা করছে কাস্টমস গোয়েন্দা। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানির তথ্য যাচাই করা হয়েছে।
হিসাব অনুযায়ী, ৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯২ কেজি এক্সেসরিজ কাঁচামাল আমদানি করেছে বন্ডেড প্রতিষ্ঠান তুয়ান প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ। তুয়ান গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা এসব কাঁচামালে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৭ কোটি ১৬ লাখ ৫ হাজার ৯৩২ টাকা। একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান তাম্মি এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ একই সময় ১০৫টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৭৩ কেজি এক্সেসরিজ আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৯ কোটি ১২ লাখ ১৭ হাজার ৯৬ টাকা। রেডিয়ান এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৯টি বিল অব এন্ট্রিতে ২৬ লাখ ৩২ হাজার ২৭৮ কেজি এক্সেসরিজ আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৪ কোটি ১৩ লাখ ২২ হাজার ৫২৭ টাকা। হোলি ইলাস্টিক লিমিটেড ৭৬টি বিল অব এন্ট্রিতে ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৪৯৭ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ৯ কোটি ৩২ লাখ ২২ হাজার ৭ টাকা। তাকওয়া ট্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ ৫৮টি বিল অব এন্ট্রিতে ১২ লাখ ৫১ হাজার ২৭২ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১০ কোটি ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৯ টাকা। মিরহা এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৩১টি বিল অব এন্ট্রিতে ৬২ লাখ ১৮ হাজার ২২৮ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে জড়িত সম্ভাব্য রাজস্ব ৩৪ কোটি ৮৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৩ টাকা। উজ্জ্বল ফ্রেবিকস লিমিটেড ১৩১টি বিল অব এন্ট্রিতে ২০ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫৪ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে জড়িত সম্ভাব্য রাজস্ব ৩৩ কোটি ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫২ টাকা। ডংহু বিডি লিমিটেড ৮২টি বিল অব এন্ট্রিতে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪০৮ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৫ কোটি ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৯৩ টাকা। ওমর গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ৩৪টি বিল অব এন্ট্রিতে ১১ লাখ ৩ হাজার ৯৭০ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১০ কোটি ৮৭ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। ৯টি প্রতিষ্ঠান এই সময়ের মধ্যে ৭৮৬টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭২ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৬৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩২ হাজার ১৬৯ টাকা।
অপরদিকে কাস্টমস গোয়েন্দার অধিকতর অনুসন্ধানের স্বার্থে এই দশটি প্রতিষ্ঠানের ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত পাঁচবছরের রপ্তানির তথ্য দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে এই পাঁচ বছরে দশটি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিতেও অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি দশটি প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখতে বন্ড কমিশনারেটকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, কিছু এক্সেসরিজ বন্ডেড প্রতিষ্ঠান প্রাপ্যতার সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন-এমন অভিযোগ পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। প্রাথমিকভাবে এক্সেসরিজ বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রির প্রাথমিক অনুসন্ধান করে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অ্যাকসেসরিজ প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করেন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বন্ড লাইসেন্সে অনুমোদিত বিভিন্ন কাঁচামালর মধ্যে কয়েকটি কাঁচামাল, যেমন-পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার, পিইউ লেদার, পিভিসি লেদার, পলিয়েস্টার টাফেটা ফেব্রিকস, প্রিন্টিং পিভিসি শিট, পলিয়েস্টার ইন্টারলাইনিং ও পিভিসি কোটেড টেক্সটাইল ফেব্রিকস প্রভৃতি অধিক পরিমাণে আমদানি করেছে। এসব কাঁচামালের খোলাবাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বন্ড কমিশনারেটকে উদ্দেশে বলেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ড লাইসেন্সে অনুমোদিত বিভিন্ন কাঁচামালের মধ্য থেকে কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্য অধিক পরিমাণে আমদানি করায় আমদানিকৃত পণ্যসমূহের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তালিকা দেয়া ৯টি প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা, আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ ও বাজারে এসব কাঁচামালের অবাধ বিচরণ দেখে তা অনুমেয়। সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি প্রাপ্যতা ও রপ্তানির তথ্য আরও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এছাড়া কাঁচামালের প্রাপ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এইচএস কোডভিত্তিক আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করে দেয়া আবশ্যক, যাতে আমদানি করে পণ্য তৈরি ছাড়া খোলাবাজারে বিক্রি করতে না পারে। এ বিষয়ে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, প্রাপ্যতা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কী কী পণ্য রপ্তানি করে, তা ভালোভাবে যাচাই করা উচিত।
এতে প্রতিষ্ঠান যে ধরনের পণ্য রপ্তানি করে, সেই পণ্য তৈরিতে প্রাপ্যতা চাওয়া সব ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার হবে কি না, তা বিশ্লেষণ করা উচিত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি প্রাপ্যতা দেয়ার ক্ষেত্রে এর আগের প্রাপ্যতার পণ্য সঠিকভাবে আমদানি করেছে কি না, কী কাঁচামাল আমদানি করেছে, কতটুকু ব্যবহার করেছে, নাকি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে, তা যাচাই করলে তো ফাঁকি বের হয়ে যাবে। বন্ড প্রতিষ্ঠান কোন কাঁচামাল কতটুকু আমদানি করবে, কোন এইচএস কোডে আমদানি করবে, তা প্রাপ্যতায় উল্লেখ থাকলে সহজে ওই প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। আর কোন কোন প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রি করে দেয়, তা নজরদারি করা ছাড়া বের করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে শতভাগ অনলাইনে কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা ছাড়া উপায় নেই।