** সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মুকুল ঢাকার একটি কমিশনারেটে একজন কমিশনারের ঘুসের ‘ক্যাশিয়ার’ ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে
** সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসে পোস্টিং পান, সেখানেও একজন কমিশনারের ঘুসের ক্যাশিয়ার ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে
** এনবিআরের একজন প্রভাবশালী সদস্য ও একজন কমিশনারের জন্য ‘ব্যাগ ভর্তি ঘুসের টাকা’ নিয়ে আসছেন মুকুল; সদস্য ও কমিশনারকে বাঁচাতে মুকুলকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে
ছিলেন একটি কমিশনারেটের কর্মচারী। সেখানে একজন কমিশনারের ‘ঘুসের ক্যাশিয়ার’ ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা। তার নাম খন্দকার মুকুল হোসেন। বদলি হলেন বেনাপোল কাস্টম হাউসে। সেখানে গিয়েও আবার হলেন কমিশনারের ‘ঘুসের ক্যাশিয়ার’! ব্যাগ ভর্তি ঘুসের ২২ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়ে যশোর থেকে ঢাকায় আসলেন বিমানে। শেষে বিমানবন্দর নিরাপত্তাকর্মীদের (এভিয়েশন সিকিউরিটি) হাতে টাকাসহ আটক হলেন। টাকার মালিক বিষয়ে একেকবার একেক তথ্য দিলেন। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে প্রথমে যে জবানবন্দী দিলেন, শেষে তা পাল্টে গেল। অভিযোগ রয়েছে, এনবিআরের প্রভাবশালী এক সদস্যের প্রভাবে সেই চিঠি ও জবানবন্দী পাল্টে যায়।
শেষে বেনাপোল কাস্টমসের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। দুদক অভিযান করলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কাস্টমসের তদন্ত কমিটি হলো। সব জায়গায় ক্ষমতার প্রভাবে টাকার মালিকের (অভিযোগ রয়েছে ঘুসের টাকা ওই সদস্য ও বেনাপোল কাস্টম হাউসের সদ্য সাবেক এক কশিনারের জন্য ঢাকায় আনা হচ্ছে) কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। টাকার উৎস সম্পর্কে জানা যায়নি। প্রায় দুই বছর পর ২০২৪ সালের ২ জুন ‘প্রভাবশালীদের’ বাঁচাতে সেই মুকুলকে বলির পাঠা বানিয়ে ‘বাধ্যতামূলক অবসরে’ পাঠানো হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে-এনবিআর চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ ওই প্রভাবশালী সদস্য সব ‘ম্যানেজ’ করে নিজে বাঁচতে এবং ওই কমিশনারকে বাঁচাতে মুকুলকে অবসরে পাঠিয়েছেন।
২ জুন খন্দকার মুকুল হোসেনকে চাকরিচ্যুত করে আদেশ জারি এনবিআর। চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সই করা আদেশে বলা হয়, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেন। বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত হিসেবে রয়েছেন। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর বেনাল কাস্টম হাউসে তিনি যোগদান করেন। ২০২২ সালের ১৪ জুলাই এই কর্মকর্তা হাউসের ৩১ নম্বর শেডের ওয়েব্রিজ, (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জিএল শাখায় কর্মরত ছিলেন।
আরো বলা হয়, ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট। এ দিন তিনি যশোর বিমানবন্দর হতে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। অবতরণের পর এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ব্যাগ তল্লাশি করেন। এ সময় তার ব্যাগের ভিতরে ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ওই দিন এভিয়েশন সিকিউরিটির একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছে, ওই টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ওই টাকার উৎসের বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। পরবর্তীতে বেনাপোল কাস্টম হাউস হতে উপকমিশনার তানভীর আহমেদ ও রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নঈম মীরনের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির তদন্তে দেখা যায়, এভিয়েশন সিকিউরিটির উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ টাকার বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। অর্থাৎ তিনি ওই টাকা অন্য কোন উপায়ে উপার্জন করেছেন বলে সন্দেহের অবকাশ হয়। এছাড়াও তিনি ২৬ আগস্ট কর্মস্থল ত্যাগ করে ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কোনো মৌখিক বা লিখিত অনুমতি গ্রহণ করেননি।
আদেশে বলা হয়, যেহেতু, সরকারের দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত থেকে খন্দকার মুকুল হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) এহেন কার্যক্রম সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (ঘ) (অ) অনুযায়ী, ‘দুর্নীতি পরায়ণ’ এবং বিধি ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য-যা এই বিধিমালার বিধি-৪ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেজন্য একই বিধিমালার বিধি (৪) মোতাবেক কেন শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না- তার কারণ সম্বলিত লিখিত জবাব ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে প্রদানের জন্য এনবিআর ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়। পরে সংশোধিত অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী প্রেরণ করা হয়। তিনি ওই অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীর জবাব প্রদান করে ব্যক্তিগত শুনানীতে আগ্রহ প্রকাশ করায় ওই বছরের ২ নভেম্বর শুনানি গ্রহণ করা হয়। শুনানি শেষে বিভাগীয় মামলার বিষয়ে প্রথম সচিব (বোর্ড প্রশাসন) গাউছুল আজমকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
আরো বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন এবং প্রাপ্ত দলিলাদির বিশ্লেষণে খন্দকার মুকুল হোসেন এর বিরুদ্ধে আনীত জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত ২২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পাওয়া এবং উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কোনো মৌখিক বা লিখিত অনুমতি গ্রহণ ব্যতিরেকে ২৬ আগস্ট কর্মস্থল ত্যাগ করার অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। খন্দকার মুকুল হোসেনের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত টাকার উৎস সন্দেহজনক মর্মে বিবেচিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (ঘ) (অ) অনুযায়ী দুর্নীতি পরায়ণ এবং বিধি ৩ (খ) অনুযায়ী অসদাচরণ এর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ওই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে গুরুদণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং একই বিধিমালার ৪(৩) (খ) বিধি অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান’ নামীয় গুরুদন্ড প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ চাওয়া হলে এই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ মোতাবেক অসদাচরণ এর অভিযোগে রুজুকৃত বিভাগীয় মামলায় একই বিধিমালার বিধি-৪ (৩) (খ) অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান’ গুরুদন্ড আরোপ করা যায় মর্মে কমিশন পরামর্শ প্রদান করেছে। সেজন্য সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ প্রদান করা হলো।
এনবিআরের একটি সূত্র জানিয়েছেন, মুকুল হোসেন ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটের একজন কর্মচারী ছিলেন। সেখানে একজন কমিশনারের (বর্তমানে এনবিআরের সদস্য) নজরে আসলে তিনি তাঁকে ‘ঘুসের ক্যাশিয়ার’ নিযুক্ত করেন। সেই থেকে মুকুল বেপরোয়া হয়ে উঠেন। সর্বশেষ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে বেনাপোল কাস্টম হাউসে তাকে বদলি করা হয়। সেখানেও একইভাবে কমিশনারের নজরে আসেন। তবে সেখানেও এনবিআরের সেই সদস্যদের সুনজরে থাকায় ‘ঘুসের ক্যাশিয়ার’ বনে যান। কমিশনারের ঘুসের টাকা প্রায় সময় ব্যাগে করে তিনি ঢাকায় পৌঁছে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই টাকার ভাগ ওই সদস্যও পেতেন। তার বাসায়ও মুকুল একইভাবে টাকা পৌঁছে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিমানবন্দরে আটক হওয়া টাকাও ওই সদস্য এবং কমিশনারের (সদ্য সাবেক) বাসায় পৌঁছে দিতে তিনি ব্যাগে করে নিয়ে আসতেছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে। এনবিআর ও বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্তের সময় নানান ধরনের গল্প (টাকার উৎস) সাজানো হয়।