প্রতীক গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে চাকরি হারালেন দুই কর্মকর্তা

এনবিআরের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা

করমুক্ত ও নগদ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে রেমিট্যান্সের (প্রবাসী আয়) নামে ৭৩১ কোটি টাকা দেশে এনেছেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই কর ছাড়ের সুবিধা দিতে রেমিটেন্স সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিল কর অঞ্চল-৫, ঢাকার দুই কর্মকর্তা। আলোচিত এই করছাড়ে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সহযোগিতা করা সেই দুই কর কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সহকারী সচিব মো. জাকির হোসেন সই করা পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

দুই কর কর্মকর্তা হলেন-এনবিআর সদস্য (চলতি দায়িত্ব) আবু সাঈদ মো. মুস্তাক। করছাড় দেওয়ার সময় তিনি কর অঞ্চল-৫, ঢাকার কর কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চলতি দায়িত্বে থাকায় তিনি কর কমিশনার হিসেবে অবসরকালীন সুবিধা পাবেন। অপর কর্মকর্তা হলেন-ট্যাকসেস আপীলাত ট্রাইব্যুনাল, দ্বৈত বেঞ্চ খুলনার সদস্য ও কর কমিশনার মো. গোলাম কবীর। করছাড় দেওয়ার সময় তিনি কর অঞ্চল-৫, ঢাকার রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দুজনেরই চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। জনস্বার্থে তাদেরকে অবসরে পাঠানো হলো। তারা বিধি অনুযায়ী অবসরজনিত সুবিধা পাবেন।

এই বিষয়ে এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভাগীয়ভাবে এনবিআরের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তার সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসান। তিনি কানাডার অন্টারিও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কোনো ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছাড়া তিনটি চীনা কোম্পানির নাম ব্যবহার করে তিনি ৭২১ কোটি টাকা প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে দেখিয়েছেন তিনি। ফারুকী হাসান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় নানা প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ কর সুবিধা নিয়েছেন। আর এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন কর অঞ্চল-৫, ঢাকার তৎকালীন কর কমিশনার, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও উপকর কমিশনার। ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তারা ফারুকী হাসানের চার করবর্ষের ২৩১ কোটি টাকার এসব অনিয়মের ফাইলটি পুনঃউন্মোচন করেও মাত্র সাড়ে ১৫ হাজার টাকার কর দাবি সৃষ্টি করে নিষ্পত্তি করেন। অভিযোগ উঠার পর এনবিআর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায়।

তবে চলতি বছরের ১৭ মার্চ এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান একটি অনুষ্ঠানে কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা আইন করলাম- প্রবাসে যারা কঠোর পরিশ্রম করেন, বিদেশ থেকে টাকা উপার্জন করে ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন; তাদের বললাম, এই টাকাটা আয়করমুক্ত। এটা প্রবাসীকর্মীদের উৎসাহিত করার জন্য ও তারা যেন রোজগারটা ফরমাল চ্যানেলে বাংলাদেশে পাঠান। আপনারা শুনে আশ্চার্য হবেন, এমন একজন করদাতা পাওয়া গেলো, যিনি ৭৩১ কোটি টাকা নিয়ে এলেন। উনি বলছেন, এটা ওয়েজ আর্নার ও করমুক্ত। আমরা এ ধরনের অন্যায় হয়তো দেখি নাই, বুঝি নাই কিংবা দেখেও না দেখার ভান করছি।’ চেয়ারম্যান বলার পরপরই বিষয়টি সামনে চলে আসে।

** ‘একজন প্রবাসী শ্রমিক ৭৩০ কোটি টাকা এনে বলছেন এটা করমুক্ত’

protik group

সূত্রমতে, প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান এস এম ফারুকী হাসান তিনটি চীনা প্রতিষ্ঠান নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন লিমিটেড, চায়না শিপবিল্ডিং ও অফসোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির থেকে ৯টি করবর্ষে ৭২১ কোটি টাকা নিয়ে আসেন। তিন চীনা কোম্পানি থেকে নিয়ে আসা টাকাকে প্রবাসী আয় হিসেবে দাবি করেন। তিনি ২০১৭-১৮ করবর্ষে প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার ১০৪ টাকা; ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৯ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩২৩ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে প্রদর্শন করেন ২৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৪ টাকা। অর্থাৎ চার করবর্ষে প্রবাসী হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ২৭২ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অথচ চার করবর্ষের এই বিশাল অঙ্কের টাকার বিপরীতে কর আইনের ৯৩ ধারায় করদাতার ফাইল পুনঃউন্মোচন করে দুই করবর্ষের মধ্যে ২০১৭-১৮ করবর্ষে মাত্র ৪৪৮ টাকা এবং ২০১৮-১৯ করবর্ষের মাত্র ১৫ হাজার ৯৫ টাকা কর দাবি সৃষ্টি করেন। আর ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে কোনো দাবি না করেই নিষ্পত্তি করেন। আর এই কাজটি করেছেন কর অঞ্চল-৫-এর তৎকালীন কমিশনার, রেঞ্জ-১-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার ও তৎকালীন এক উপকমিশনার। সূত্র আরও জানায়, প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়ে প্রদর্শন করেন ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ করবর্ষে। আলোচ্য সময়ে তিনি প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেন ৫০০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২২-২৩ করবর্ষে প্রবাসী আয় হিসেবে আয়কর ফাইলে প্রদর্শন করেন ৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ টাকা আর ২০২৩-২৪ করবর্ষে প্রবাসী আয় দেখান ৮১ কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৪৪ টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার ১০৪ টাকা; ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৯ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩২৩ এবং ২০২০-২১ করবর্ষে ২৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৪ টাকা প্রবাসী আয় দেখান। এরও আগে ২০১২-১৩ করবর্ষে প্রবাসী আয় দেখান ১ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৪ টাকা ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা। তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনী বছর এবং সরকারের কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগের বছরে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ অস্বাভাবিক প্রবাসী আয়ের নামে টাকা নিয়ে এসেছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রভাশালী নেতা এস এম ফারুকী হাসান। এনবিআরের আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৯১-এর ষষ্ঠ তপশিলের পার্ট-এ অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুযায়ী, দেশে অবস্থান করে প্রবাসী আয় হিসেবে করমুক্ত আয় দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। একই আইনের ৯৩ ধারা অনুযায়ী, পরবর্তী করবর্ষে কর মামলা হিসেবে আয়কর ফাইল পুনঃউন্মোচন করার সুযোগ রয়েছে।

ফারুকী হাসান মূলত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। তিনি কানাডার অন্টারিও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মালিকানাধীন প্রতীকে গ্রুপের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রাজধানী গুলশান-২ অবস্থিত হোটেল লেক ক্যাসেল, প্রতীক সিরামিক লিমিটেড, প্রতীক ডেভেলপার্স লিমিটেড, প্রতীক ফুড অ্যান্ড এলাইড, প্রতীক লজিস্টিকসহ বেশকিছু কোম্পানি। ফারুক হাসান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইরও সদস্য। বিগত সরকার তাকে সিআইপি মর্যাদায়ও ভূষিত করেছে।

** প্রতীক গ্রুপের ফারুকী-ই ৭৩০ কোটির সেই ব্যক্তি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!