বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হলো ফেসবুক। ফেসবুক স্ক্রলে ১৫ সেকেন্ডের যে বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তা থেকে মুহূর্তে দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে বহুজাতিক এই ফেসবুক। শুধু ফেসবুক নয়, জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল, ক্লাউড কম্পিউটিং আমাজন, বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, ভিডিও স্ট্রিমিং জুম, সামাজিক মাধ্যম লিংকডইন ও ড্রপবক্সের মতো প্রতিষ্ঠানও দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর মূসক নিবন্ধিত ১৮টি প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে আয় করে প্রায় ৮৩৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। সে হিসেবে বহুজাতিক এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে নিয়ে গেছে গড়ে ৬৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা প্রতিদিন দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১৮ কোটি টাকা আয় করে নিয়ে গেছে ফেসবুক। আর সর্বশেষ অর্থবছর এই আয় থেকে সরকার ভ্যাট পেয়েছে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও অনলাইন বিজ্ঞাপনের যে পেমেন্ট হয়, তার ওপর সরকার কোনো ভ্যাট পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে অনলাইনে বিজ্ঞাপন মনিটরিংয়ে এনবিআর বা ভ্যাট অফিসের সক্ষমতা নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানের দেয়া হিসাবের ওপর নির্ভর করতে হয়। মনিটরিং করা গেলে ভার্চুয়াল জগতের বিজ্ঞাপন থেকে সরকার আরও বেশি ভ্যাট আদায় করতে পারত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর সূত্রমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১৮টি অনাবাসিক মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আয়ের ওপর ভ্যাট ও রিটার্ন দিয়েছে। চলতি বছর নতুন করে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান মূসক নিবন্ধন নিয়েছে। নতুন নিবন্ধন নেয়া প্রতিষ্ঠান দুটি হলো গুগল ডিজিটাল ইন ও প্যাডেল ডট কম মার্কেট। ১৮টি অনাবাসিক প্রতিষ্ঠান হলো সার্চ ইঞ্জিন গুগলের দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো গুগল এশিয়া প্যাসিফিক পিটিই লি. ও গুগল আয়ারল্যান্ড লি.। ফেসবুকের তিনটি হলো ফেসবুক আয়ারল্যান্ড লি., ফেসবুক পেমেন্টস ইন্টারন্যাশনাল লি. ও ফেসবুক টেকনোলজিস আয়ারল্যান্ড লি.। নেটফ্লিক্স পিটিই লি., আমাজন ডট কম সার্ভিসেস, আমাজন অ্যাডভারটাইজিং এলএলসি, আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস ইন., লিংকডইন সিঙ্গাপুর পিটিই লি., জোহো করপোরেশন পিটিই লি., জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস ইন., মাইক্রোসফট রিজিওনাল সেলস পিটিই লি., টারনি টিন ইন্ডিয়া, প্রক্সিমা ভেটা পিটিই, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ইউকে, ড্রপবক্স ইন্টারন্যাশনাল আয়ারল্যান্ড ও দি রকেট সায়েন্স গ্রুপ এলএলএল।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও প্রযুক্তি খাতের ১৮টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন খাত থেকে আয় করে নিয়ে গেছে প্রায় ৮৩৩ কোটি ছয় লাখ টাকা। সে হিসেবে এই ১৮টি প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে দেশ থেকে নিয়ে গেছে গড়ে ৬৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা প্রতিদিন দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর এক বছরে আয়ের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়েছে ১২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। হিসাবে আরও দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দিকে আয় ও ভ্যাট আদায় কম হলেও শেষ দিকে আয় ও ভ্যাট আদায় বেড়েছে।
অপরদিকে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা নিয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে মূসক নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান সর্বশেষ অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে প্রায় ৩১৮ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট দিয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এছাড়া সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান প্রক্সিমা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ২৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আয় করেছে, যাতে ভ্যাট দিয়েছে প্রায় ৩৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর গুগলের তিনটি প্রতিষ্ঠান আয় করেছে প্রায় ১৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যাতে ভ্যাট দিয়েছে প্রায় ২২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এছাড়া আমাজনের তিনটি প্রতিষ্ঠান ৩৭ কোটি ১০ লাখ টাকার বিপরীতে ভ্যাট দিয়েছে পাঁচ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, নেটফ্লিক্স ২৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে চার কোটি আট লাখ টাকা, মাইক্রোসফট ১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা, জুম ভিডিও আট কোটি ৪৫ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা, জোহো করপোরেশন এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে ২৭ লাখ টাকা, টারনি টিন দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে ৩৬ লাখ টাকা, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ছয় কোটি ৮০ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে এক কোটি টাকা, ড্রপবক্স এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে ২৪ লাখ টাকা ও দি রকেট সায়েন্স ৭১ লাখ টাকা আয়ে ভ্যাট দিয়েছে ১০ লাখ টাকা।
অপরদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ফেসবুক ও গুগলের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও প্রযুক্তি খাতের ২০টি অনাবাসিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে প্রায় ৫০ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যার বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়েছে প্রায় সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছর জুলাই মাসে আয় হয়েছে ২৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট দিয়েছে প্রায় চার কোটি ১১ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের জুলাইয়ের চেয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে আয় বেড়েছে প্রায় ২২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর ভ্যাট বেড়েছে প্রায় তিন কোটি ৪১ লাখ টাকা। আদায় প্রবৃদ্ধি ৮৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।
অপরদিকে জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশে ছাত্র-জনতা আন্দোলন গড়ে তোলে। জুলাইয়ের শেষ দিকে আন্দোলন চাঙা হয়। পুলিশের গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা শহিদ ও অসংখ্য আহত হন। শেষে এই আন্দোলন সরকার পতনের অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দেশের মানুষ ১৬ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পায়। সেই ঐতিহাসিক আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যম ও প্রযুক্তি খাতের এসব প্রতিষ্ঠানের আয় জুলাইয়ের তুলনায় কমে যায়, যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে যায় ভ্যাট আদায়। আগস্ট মাসে ২০টি অনাবাসিক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে প্রায় ৫৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয়েছে প্রায় আট কোটি পাঁচ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছর আগস্ট মাসে আয় হয়েছে ৫১ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যার বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয়েছে প্রায় সাত কোটি ৭১ লাখ টাকা। যদিও গত অর্থবছরের আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের আগস্ট মাসে আয় বেড়েছে দুই কোটি ২৯ লাখ টাকা বেড়েছে। আর ভ্যাট বেড়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। আদায় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্ট মাসে আয় ও ভ্যাট দুটোতেই ধাক্কা লেগেছে। আর চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসের রিটার্ন দাখিল এখনও শেষ হয়নি।
ভ্যাট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি ছিল না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলাতে এই ধাক্কা লেগেছে। তাদের আয় কমে যাওয়ার ফলে ভ্যাট আদায়ও আশানুরূপ হয়নি। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যাট আদায় বাড়তে পারে।
অনলাইন বিজ্ঞাপন মনিটরিংয়ে সক্ষমতা নেই
সূত্রমতে, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে ভার্চুয়াল জগৎ ফেসবুক, গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে দেশের কোন প্রতিষ্ঠান কতটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তা মনিটরিংয়ে এনবিআর বা ভ্যাট অফিসের সক্ষমতা নেই বা মনিটরিং করতে পারে না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিমাসে দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) যে আয় দেখায়, তা মেনে নিয়ে ভ্যাট অফিসকে ভ্যাট আদায় করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এসব ভার্চুয়াল জগতে বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের পেমেন্ট দেশের বাইরে করা হয়। দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে পরিশোধিত না হওয়ায় এসব বিজ্ঞাপন থেকে সরকার ভ্যাট পায় না। আবার দেশের মধ্যেও কিছু বিজ্ঞাপনের বিল ব্যাংকিং চ্যানেলে পরিশোধিত হয় না। এছাড়া জনপ্রিয় ভিডিও স্ট্রিমিং ইউটিউব এখনও বাংলাদেশে মূসক নিবন্ধন নেয়নি। এই প্রতিষ্ঠানে বহু দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট পায় না।