প্রতিনিয়ত ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে, যার ফলে কাস্টমস সংক্রান্ত অনেক জটিলতার সমাধান করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। ব্যবসায়ীদের পণ্য শুল্কায়ন সংক্রান্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এমসিসিআই ও এফআইসিসিআইয়ের সঙ্গে এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিদেশ থেকে কম দামে পণ্য আমদানি করলেও খালাসের সময় ‘ইনভয়েস’ (পণ্যসহ আমদানি মূল্যের তালিকা) বাদ দিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা নিজেদের মত করে মূল্যায়ন করার অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এর জবাবে সরকার পতনের পর দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থার দায়িত্বে আসা আবদুর রহমান খান বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা যখন দেখতে পাচ্ছেন যে ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনছে, তখন তাদের প্রশিক্ষণই হচ্ছে সন্দেহ করা।
তাদের ট্রেনিংই হচ্ছে তোমাকে সন্দেহ করতে হবে যে ঠিক মত ডিক্লারেশন (মূল্য ঘোষণা) দিচ্ছে না। যদি আইডিয়াল সিচুয়েশন থাকত, তাহলে তো যার যার ইনভয়েস অনুযায়ী হত। কিন্তু বাস্তবতা হল এটা না।এসময় ব্যবসায়ীদের লেনদেনের সব তথ্য না দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা যতক্ষণ সত্য এবং ন্যায়ের ওপর দাঁড়াইতে না পারব, ততক্ষণ আমাদের এই সমস্যা যাবে না।
সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যেমন আমি এবার গ্রামে গেলাম, গত উইকেন্ডে। কোথা থেকে কল পাইছে, আমি চিনিও না। সে এসে বলল, আমি প্রথম আনছি মাল। এই হইছে, এইচএসকোড ভুল হইছে। অনেক টাকা ট্যাক্স করতেছে। তো আমি ট্যাক্স দিয়ে দিব। আমাকে যেন জরিমানা না করে।
জরিমানা তো ২০০ শতাংশ। তাও তার প্রথমবারের মত। দেখলাম এটা তার গুরুতর অপরাধ যে সে যে মাল আনছে আর যে মাল ঘোষণা দিছে, সে বলতেছে সে প্রথম করছে, এই তার প্রথম ইমপোর্ট, প্রথম ইমপোর্টেই যদি, বিসমিল্লাহে যদি এই কাজ করে যে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার মত অবস্থা। প্রবলেমটা হল এই জায়গাতে।তার ভাষ্য, আমাদের ব্যবসায়ীরা, আপনারা সবাই জানেন, দেখা গেল আপনার যা ট্রাঞ্জেকশন হয়, আপনি সব অ্যাকাউন্টসে আনেন না। একটা বড় ফিগার অ্যাকাউন্টসের বাইরে রেখে দেন। এটাও ওরা জানে।
আবার পুরোটা আনলে যতটা ট্যাক্স আসবে তা বেয়ার করার ক্ষমতা আপনার নাই, তাই ভাবেন একটু সরায়া রাখি। এটাও তারা জানে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যতক্ষণ সত্য এবং ন্যায়ের ওপর দাঁড়াইতে না পারব, ততক্ষণ আমাদের এই সমস্যা যাবে না।
নন-কমপ্লায়েন্সের খরচ ‘অসহ্য’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্ট ট্যাক্সপেয়াররা কেন কমপ্লায়েন্ট থাকে? কারণ তারা জানে, নন-কমপ্লায়েন্সের খরচ অসহনীয়। একবার যদি কেউ নন-কমপ্লায়েন্সে পড়ে, যেমন এই ইমপোর্টারের উদাহরণ, সে আর কখনো ব্যবসা করতে পারবে না। এবং আমি নিশ্চিত, তার মাল নিলামে চলে যাবে। কারণ, নিয়মিত ডিউটি ছাড়াও ২০০ শতাংশ জরিমানা ও অন্যান্য খরচ যোগ হয়ে যে ট্যাক্স আসবে, তা পরিশোধ করার পর সে মাল কখনোই নিতে পারবে না।
নগদ লেনদেনের শর্ত তুলে দেওয়ার প্রস্তাব
বিগত কয়েক অর্থবছরে করপোরেট করহার কমানো হলেও, নগদ লেনদেনের শর্তের কারণে তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেছে এফআইসিসিআই এবং এমসিসিআই। এফআইসিসিআইয়ের করবিষয়ক উপদেষ্টা স্নেহাশীষ বড়ুয়া সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাবে করপোরেট কর কার্যকর হারের ‘অপটিমাইজেশন’ জন্য নগদ লেনদেনের থ্রেশহোল্ড প্রত্যাহার, উৎসে করের বিধান সংস্কার এবং ধাপে ধাপে ন্যূনতম কর বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপগুলো একটি প্রতিযোগিতামূলক কর পরিবেশ তৈরি করবে, যা পরবর্তীতে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ প্রবাহে উৎসাহ যোগাবে।
এমসিসিআই সভাপতি কামরান তানভীরুর রহমান বলেন, বিগত অর্থবছরগুলোর মধ্যে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট করহার ধারাবাহিকভাবে কমানো হলেও, নগদ লেনদেনের শর্তের কারণে কেউই এই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক, যেখানে ব্যাংকিং নির্ভরতা পুরোপুরি নেই, ফলে বড় ও মাঝারি কোম্পানির জন্য এই শর্ত পালন করা অত্যন্ত কঠিন। এছাড়া, কার্যকরী করহার অতিমাত্রায় উচ্চ, যা উৎসে কর কর্তন এবং অননুমোদিত ব্যয়ের কারণে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। তিনি আরও বলেন, করপোরেট করহার বাস্তবিক হারে কমানোর পাশাপাশি, অগ্রিম আয়কর ও টার্নওভার কর নীতির সংস্কার প্রয়োজন, যাতে কর আয়ভিত্তিক হয়, টার্নওভারের উপর নয়।
এর প্রেক্ষিতে, ‘কর প্রশাসনের উন্নয়ন এবং স্বয়ংক্রিয় ডিজিটালাইজেশন চালুর মাধ্যমে কর ফাঁকি কমানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তাই কোম্পানির করহারের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্ত বাতিলের’ প্রস্তাব করেন তিনি। আলোচনা সভায় এফআইসিসিআই সভাপতি জাভেদ আখতার এবং এমসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিমিন রহমান অংশ নেন।