টাকার অভাবে গ্যাস সরবরাহের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। একই গ্যাসের জন্য পেট্রোবাংলার কাছ থেকে দুটি শুল্ক-কর নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যার ফলে এনবিআরের কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই লোকসান কমাতে এখন তারা আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং অন্যান্য কর প্রত্যাহারের অনুরোধ করছে।
অর্থনৈতিক ঘাটতি কমাতে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা, যা বর্তমানে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দ্বারা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। প্রস্তাবটি কার্যকর হলে পেট্রোবাংলার আয় তিন হাজার কোটি টাকা বাড়বে। তবে, যদি আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর প্রত্যাহার করা হয়, তবে পেট্রোবাংলা ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে। পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতি ইউনিট গ্যাসের আমদানি মূল্য ১৪ ডলার, এবং প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে বছরে ১০০ কার্গো আমদানির মাধ্যমে এই পরিমাণ সাশ্রয় সম্ভব।
পেট্রোবাংলা বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সময় তাদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ উৎসে কর দিতে হচ্ছে। এর বাইরে পেট্রোবাংলাকে এলএনজি মার্জিনের বিল পরিশোধের সময় গ্যাস বিতরণ সংস্থার কাছ থেকে ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হচ্ছে। এভাবে বাড়তি রাজস্ব আদায় করে পেট্রোবাংলাকে আবার ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। যদিও শুধু আমদানি পর্যায়ে ১৭ শতাংশ ভ্যাট ও কর প্রত্যাহার করা হলে ভর্তুকির তেমন প্রয়োজন হবে না পেট্রোবাংলার।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের বকেয়া পাওনা জমেছে ১৭ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এলএনজি কিনতে সরকারের কাছ থেকে পেট্রোবাংলাকে নিয়মিত ভর্তুকি নিতে হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার জন্য ভর্তুকি বরাদ্দ আছে ছয় হাজার কোটি টাকা। চাহিদামতো এলএনজি আমদানি করা হলে ভর্তুকি লাগবে দ্বিগুণের বেশি। অথচ মাত্র ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়িয়েছে জ্বালানি বিভাগ। বর্তমানে এলএনজির বিল ছাড়া অন্য কোনো দায় পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না; কিন্তু এনবিআরের কাছে বিপুল দেনা বকেয়া থাকায় এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পেট্রোবাংলা তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বকেয়ার কারণে আস্থা হারাচ্ছে এলএনজি সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি। তারা দরপত্রে এখন বাড়তি দাম প্রস্তাব করছে। বাজারের চেয়ে বেশি দাম প্রস্তাব করায় একাধিক দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হলে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া চাহিদামতো এলএনজি আমদানি করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে, লোডশেডিং বাড়বে।
পেট্রোবাংলা বলছে, সাধারণত আমদানি করা পণ্যের উপর দুই পর্যায়ে ভ্যাট নেয় এনবিআর, কারণ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং মানে ভ্যালু অ্যাডিশন ঘটে। তবে গ্যাসের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন; বেশি দামে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই, দুই পর্যায়ে ভ্যাট এবং তিন পর্যায়ে আয়কর পরিশোধের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যদি আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর কমানো হয়, তবে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস বিক্রি থেকে এনবিআর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে।
সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর প্রত্যাহারের বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এনবিআর আপত্তি না করলেও, এটি কার্যকর করার জন্য সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। পরে পেট্রোবাংলা জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে, এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা নীতিগতভাবে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। গত মাসে পেট্রোবাংলা এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং ৯ মার্চ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআরের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এলএনজির ভ্যাট নিয়ে শিগগিরই এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীন কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত এলএনজি কেনা হয়। এর বাইরে চাহিদা অনুসারে খোলাবাজার থেকেও এলএনজি আমদানি করা হয়। উচ্চ দামে এলএনজি কিনে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রণ করে আট শ্রেণির ভোক্তার কাছে সরবরাহ করা হয়। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় এলএনজি আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে নিয়মিত। এতে পেট্রোবাংলার খরচ বাড়ছে।
বর্তমানে পেট্রোবাংলার প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহের খরচ ২৯ টাকা ৩৯ পয়সা, কিন্তু তারা এটি ২২ টাকা ৮৭ পয়সায় বিক্রি করছে। এর ফলে লোকসান পূরণের জন্য প্রতিবছর সরকার থেকে ভর্তুকি নিতে হয় তাদের। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৩২ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৫ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়েছে পেট্রোবাংলা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তাই খরচ কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে পেট্রোবাংলা, যার মধ্যে এলএনজি আমদানির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুধু এলএনজি নয়, অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা রয়েছে। এনবিআর রাজস্ব আয়ের সহজ সুযোগ হারাতে চায় না, কিন্তু ভর্তুকি ও উচ্চ দামের ক্ষতিকর প্রভাব তাদের বিবেচনায় নেই। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারে। বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট আরোপের কারণে উচ্চমূল্যে জ্বালানি কিনে তা ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ভ্যাট প্রত্যাহার করে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের একটি সমাধান বের করা উচিত।