হাসিনা সরকারের সময়ে পুলিশের জন্য আমদানি করা ৭৫টি স্নাইপার রাইফেল আটকে দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত বছরের জুনে এ অস্ত্র আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন দমন ও সরকারবিরোধী জনসমাবেশে দমন-পীড়নের উদ্দেশ্যেই এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুলিশের এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি না থাকায় এগুলো খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না।
কাস্টমসের আমদানি তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনে এসব অস্ত্র আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে পুলিশ। সেপ্টেম্বরে এসব অস্ত্র দেশে আসে। কিন্তু মারণাস্ত্র বা ভয়ংকর এসব অস্ত্রের জন্য বৈধ কোনো কাগজ নেই পুলিশের কাছে। ফলে ঢাকা কাস্টমস হাউসে কয়েক মাস ধরে আটকে রয়েছে এসব অস্ত্র খালাসের প্রক্রিয়া।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব জানান, মন্ত্রণালয়ের আর্মস ডিভিশনের বিধি অনুযায়ী পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে পুলিশ সরকারের অনুমতি নিয়ে যেকোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এক্ষেত্রে স্নাইপার কোনো ইস্যু নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, ‘কাস্টমসে আটকে থাকা অস্ত্রের ব্যাপারটি আমার জানা নেই।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র-জনতার ওপর নজিরবিহীন হামলা চালায় পুলিশ। ১৯ থেকে ২১ জুলাই তিন দিনে ওই এলাকায় আন্দোলনকারীদের দমাতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়না রাইফেল থেকে এক হাজার ৪৯৫ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এতে প্রাণহানি ঘটে শতাধিক। অত্যাধুনিক এই মারণাস্ত্র দিয়ে প্রতি মিনিটে নির্ভুলভাবে ৩০ থেকে ৪০ রাউন্ড গুলি চালানো যায়, যা সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হাসিনার নির্দেশে জুলাই আন্দোলন দমাতে অন্তত শতাধিক স্থানে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশ।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়নের নামে বিভিন্ন মারণাস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়না রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, বিডি-৮ অ্যাসল্ট রাইফেল এবং টরাস ৯ এমএম অস্ত্র সংযোজন করা হয়। পুলিশের হাতে এ ধরনের অস্ত্র তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর নেওয়া হয়। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আখতার হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয় এবং তার প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এ অস্ত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া তড়িঘড়ি বাস্তবায়িত হয়, যদিও সরকারি কেনাকাটার প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।
২০১৫ সালে প্রথম দফায় ইতালি থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গুলি আমদানি করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আরো মারণাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। আখতার হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে এসব অস্ত্র সংগ্রহ এবং বিতরণ কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদোন্নতি পান এবং ২০২২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। পরে তিনি ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবিষয়ক (এসডিজি) মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পান।
একটি সূত্রের মতে, প্রথমে বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের জন্য এসব অস্ত্র সংগ্রহ করা হলেও পরে তা বিরোধী মত দমন ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ব্যবহার করা হতে থাকে। ২০১৪ সালের পরবর্তী নির্বাচনগুলোর আগে ও পরে পুলিশের অস্ত্র সংগ্রহের তৎপরতা বেড়ে যায়।অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, পুলিশ ও র্যাব চায়না টাইপ-৫৬ সেমি অটোমেটিক রাইফেল ও ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম বুলেট ব্যবহার করে।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করা হয়। আহতদের অস্ত্রোপচারের পর পাওয়া বুলেটের নমুনা পরীক্ষা করে অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব গুলি প্রাণঘাতী ছিল। নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে অনেক রোগীর মাথায় স্নাইপার রাইফেলের গুলি লেগে মস্তিষ্কের মারাত্মক অবস্থা হয়েছিল। অনেকে মারা গেছেন এবং কেউ কেউ অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন।
নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডা. হাসান জানান, এখানে ভর্তি বেশিরভাগ রোগীরই মাথায় গুলি লেগেছে এবং অধিকাংশকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। স্নাইপার রাইফেলের গুলির আঘাত অত্যন্ত ভয়াবহ, যা সাধারণ বুলেটের তুলনায় অনেক বড় ও প্রাণঘাতী।গণঅভ্যুত্থানে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। আহতদের অনেকেই এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।