পিওরইট: নামের পিওর, মানে নয়!

২০২৪ সালের নভেম্বরে ইউনিলিভারের পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি ‘পিওরইট’ ১২০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এও স্পিথ করপোরেশন। তবে মালিকানা বদল হলেও, ইউনিলিভারের নামেই এখনো ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, পিওরইট পণ্যের মান বর্তমানে অত্যন্ত নিম্নমানের এবং নির্ধারিত পরিমাণ পানি বিশুদ্ধ করতে পারছে না। ৩ হাজার কিংবা ১ হাজার ৫০০ লিটার পানি বিশুদ্ধ করার কথা থাকলেও, অনেক কিট তার অর্ধেক পরিমাণ পানিও সঠিকভাবে বিশুদ্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। গ্রাহকসেবার জন্য নির্ধারিত ১৬৬২৭ নম্বরে যোগাযোগ করেও সঠিক সেবা পাচ্ছেন না অনেকেই। অভিযোগ করেও সমস্যার কোনো সমাধান মিলছে না বলে জানাচ্ছেন তারা।

পণ্যের মানোন্নয়ন, গ্রাহকের বিক্রয়োত্তর সেবা ও সন্তুষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে ১৫ এপ্রিল এও স্পিথ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কেভিন জে হুইলারের কাছে মেইলে জবাব চাইলেও প্রতিউত্তর আসেনি। অন্যদিকে, ‘পরিমাপ মানদণ্ড নিশ্চিত’ করতে না পারায় পিওরইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এও স্পিথ করপোরেশন গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ না করে বাংলাদেশ ছাড়াও চারটি দেশে পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিনটি বিক্রি করছে। তবে শুধু বাংলাদেশে পণ্যের শ্রেণিকরণ নেই এবং বিক্রিত পণ্য বিনষ্ট বা মানহীন হলেও ফেরত নেওয়ার বিধান রাখেনি। অভিযোগকারী বা সেবাগ্রহণকারীকে বিক্রয়োত্তর সঠিক সেবা না দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে আয়ের পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভোগান্তিতে ক্রেতারা

দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে থাকা মূল্যস্ফীতির শহর ঢাকা। সেখানে পানি বিশুদ্ধকরণ একটি টেকনোলজিটি পিওরইটের মূল্য (১৫শ লিটার) ৪ হাজার ৯৯৯ টাকা। ঊর্ধ্বমূল্যে খাবি খাওয়া ঢাকায় ‘৭৫০ লিটার পানি বিশুদ্ধ করার আগেই কিট শেষ হয়েছে’ বলে অভিযোগ করেন পণ্যটির ক্রেতা রাজধানীর মগবাজার পেয়ারাবাগের আয়শা আক্তার। তার সঙ্গে আরও অনেকেই একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ৩১ অক্টোবর মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেটের পাশে বেস্টবাই থেকে ৫ হাজার টাকায় একটি পিওরইট কিনি। বাসায় আমরা দুজন মানুষ। একজন সকালে বেরিয়ে যান এবং রাতে ফেরেন। ৫ মাসেই অর্থাৎ মার্চ মাসের শেষে নতুন কিট শেষ; এখন আবার কিট কেনার কথা বলা হচ্ছে। ৫ হাজার টাকায় পিওরইট কিনে ৭৫০ লিটার বিশুদ্ধ পানিও ব্যবহার করিনি। এই ৫ মাসের মধ্যে আমি গ্রামের বাড়িতেও ১০ দিন ছিলাম।’

‘পিওরইটে’র গায়ে থাকা ১৬৬২৭ নম্বরে ফোন করা হলে তাদের একজন প্রতিনিধি বাসায় এসে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার পানিতে বেশি আয়রন থাকায় এবং তাপমাত্রা বেশির কারণে তাড়াতাড়ি কিট শেষ হয়েছে। বাধ্য হয়ে পিওরইটটি বিনা শর্তে তাদের ফেরত নিয়ে যেতে বলি। তারা জানায়, ফেরত নেওয়ার নিয়ম নেই। চাপ দিলে খারাপ আচরণ করে।’

অস্পষ্টতায় বিক্রয় প্রতিনিধিরা

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। কারওয়ানবাজার, মগবাজার ও মালিবাগ ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানে বিশ্বখ্যাত ইউনিলিভারের নামে এবং গায়েও ট্যাগ লাগিয়ে পিওরইট বিক্রি করা হচ্ছে। গ্লোবাল ওয়াটার টেকনোলজি কোম্পানি এও স্মিথ করপোরেশন নভেম্বরে এটি কিনে নিয়েছে কিন্তু বিক্রয় প্রতিনিধিরা তা জানেন না। এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তাদের বলা হয়নি। এ কারণে আরএফএল কোম্পানির পণ্য ‘ড্রিংকইট’ বিক্রি করছেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা। জানতে চাইলে মগবাজারের আরএফএল কোম্পানির বেস্টবাই দোকানের অন্য বিক্রয় প্রতিনিধি মুন্না বলেন, ‘১২০ মিলিয়ন ডলারে আমেরিকান কোম্পানি কিনেছে তা আমরা জানতাম না। তবে পিওরইট এখন কম আসছে।’

ফ্রি কিট দিয়েই ম্যানেজ করার পরিকল্পনা

‘পিওরইটে’র গায়ে থাকা ১৬৬২৭ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানালে ঢাকা রামপুরা জোনের এক পরিদর্শকের সঙ্গে কথা হয়। প্রথমে অভিযোগ মানতে নারাজ এবং অনেক উচ্চবাক্য করেন। পরে ‘পানিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি ও তাপমাত্রা অধিকের কারণে দ্রুত কিট শেষ হয়েছে’ বলে জানান। দ্বিতীয় দিনে ঊর্ধ্বতন আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা হয়। তারাও মূল বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। হটলাইনের বাইরে সাক্ষাতে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। পরে সংবাদকর্মীর পরিচয় দিলে বিনয়ী হন এবং সংবাদে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। তৃতীয় দিনে পিওরইটের ঊর্ধ্বতন একজন অনুরোধ করে বলেন, ‘সংবাদটি প্রকাশ করবেন না। এতে অনেকের খারাপ হবে, চাকরিও চলে যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ফ্রি নতুন একটি কিট দিচ্ছি। বিষয়টি কাউকে বলবেন না।’

ভোক্তা অধিকার কার্যক্রমে ঘাটতি

‘পরিমাপ মানদণ্ড নিশ্চিত’ করতে না পারা ‘হাইপোথিক্যাল’ হওয়ায় পিওরইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলে জানান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুম আরেফিন। তিনি বলেন, ‘পিওরইট’ সম্পর্কে অভিযোগ আগেও এসেছে। কিন্তু পরিমাপক মানদণ্ড নিশ্চিত না হওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে সেদিকেও দৃষ্টি আছে। কেউ যদি সরকারের পরিমাপক নিশ্চয়তা প্রদানকারী কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নিশ্চয়তা কপিসহ অভিযোগ করে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।’

ইউনিলিভারের বক্তব্য

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার কাস্টমার কেয়ার লিমিটেড। বহুজাতিক কোম্পানির সেক্রেটারি মোহাম্মদ নাহারুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘ইউনিলিভার কাস্টমার কেয়ার লিমিটেড বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশের সর্বত্র সরবরাহ করে। নির্দিষ্ট বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে উন্নতমানের পণ্য দায়িত্ব নিয়ে সরবরাহ করা হয়। তবে এখন পিওরইট ইউনিলিভারের পণ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইউনিলিভার বাংলাদেশ নামে আরেকটি কোম্পানি আছে, সেটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। সেটির প্রডাক্ট ছিল পিওরইট; এও স্মিথ কোম্পানির কাছে এটি বিক্রি করা হয়েছে। দেখভাল এখন তারাই করে।’

১২ কোটি ডলারে পিওরইট বিক্রি

বাংলাদেশে ইউনিলিভার ২০১০ সালে পিওরইট চালু করে। চালুর পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে ১২০ মিলিয়ন ডলারে ইউনিলিভার থেকে খাবার পানি শোধনকারী পিওরইট কিনে এও স্মিথ করপোরেশন। তথ্যটি ওয়েবসাইটে জানিয়েছে এও স্মিথ করপোরেশন। আমেরিকান এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কেভিন জে হুইলার। পিওরইট প্রথম ২০০৪ সালে ভারতের চেন্নাইতে চালু করা হয়েছিল।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং এর বাইরে সহজলভ্য এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে এটি চালু করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিলিভার পিওরইট বিক্রি থেকে বছরে ৬০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও পিওরইট বর্তমানে শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম এবং মেক্সিকোয় বিক্রি হচ্ছে। পিওরইট অধিগ্রহণের চুক্তিটি এই বছরের শুরুতে ঘোষণা করা হয়েছিল। এও স্মিথ ১৮৭৪ সালে অটোমোবাইল সেক্টরে ব্যবসা শুরু করে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি অটোমোবাইল ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ টেকনোলজি খাতে ব্যবসা শুরু করে।

জবাব আসেনি মেইলের

এও স্মিথ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কেভিন জে হুইলারের কাছে ১৫ এপ্রিল মেইল পাঠানো হয়। ই-মেইলে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশে নতুন ব্যবসায় আপনাকে স্বাগতম। পৃথিবীর অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশেগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে আপনার প্রতিষ্ঠান। যা সেবার মাধ্যমে মুনাফা করা, ঐতিহ্য রক্ষা ও সুনাম অর্জনের মহৎ উদাহরণ। তবে ইউনিলিভার থেকে ‘পিওরইট’ হাত বদলের পরে বাংলাদেশে আপনার প্রতিষ্ঠান সুনাম হারাতে বসেছে। কারণ, পণ্যের মান নিম্ন মানের এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে ব্যর্থ হচ্ছেন গ্রাহক। তাদের অভিযোগ, পিওরইট নির্ধারিত ৩০০০/১৫০০ লিটার পানি বিশুদ্ধ/ফিল্টার করতে পারছে না। প্রত্যেক কিট নির্ধারিত পরিমাপের অর্ধেক পানি বিশুদ্ধ দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে।

অন্যদিকে, গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পিওরইটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘আক্রমণাত্মক ভাষা ও অসংগতিপূর্ণ ব্যাখ্যা’ আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের অনেকেই পিওরইটকে ‘মানহীন পণ্য’ হিসেবে অভিহিত করে বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরছেন। পাশাপাশি, তারা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও অভিযোগ জানাচ্ছেন। তবে বিস্ময়করভাবে, প্রয়োজনীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এসব অভিযোগ ‘কাল্পনিক’ বা ‘হাইপোথেটিক্যাল’ বলে বিবেচিত হওয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণে পিছিয়ে থাকছে কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশে এও স্মিথ করপোরেশন আসলে গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে কী করছে? যেসব ভোক্তা প্রতারিত হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের জন্য কি কোনো কার্যকর বিক্রয়োত্তর সেবা বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে?

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!