সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং ১০ শিল্প গোষ্ঠীর ‘পাচার করা’ অর্থ ফেরত আনতে একসঙ্গে কাজ করবে রাষ্ট্রের তিন সংস্থা।
দুদককে মূল ভূমিকায় রেখে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর যৌথভাবে এ কাজ করবে।
তাদের কাজ সমন্বয় করবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থপাচার, কর ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
বিদেশে টাকা পাচার করে সেই অর্থে ব্যবসার মালিকানা এবং ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনায় বিনিয়োগ করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ডিসেম্বরে দাখিল করা শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে গড়ে প্রতি বছর ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ‘পাচার’ হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কাজ শুরু হওয়ার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ইউরোপী ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে আশ্বাস মিলেছে। কূটনৈতিক পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে।
দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় থাকা শিল্প গ্রুপগুলো হল- বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, এস আলম, জেমকন, নাবিল, নাসা, ওরিয়ন, সিকদার, আরামিট ও সামিট। এসব গ্রুপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, এ বিষয়ে ১১টি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। এই দলগুলো সিআইডি ও এনবিআরের সঙ্গে যৌথভাবে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করবে।
তিনি বলেন, “অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান ও পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে তৎপরতা রয়েছে দুদকের। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে সেগুলো অনুসন্ধান করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সুযোগ নেই। অনুসন্ধান বিধি অনুযায়ী কাজ করতে দুদকের কর্মকর্তারা স্বাধীন। এ ক্ষেত্রে তারা অপরাধ প্রমাণে প্রয়োজনীয় নথি ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে তলবও করতে পারবেন। অভিযোগের প্রমাণ মিললেই সংশ্লিষ্ট বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।”
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গভর্নর মনসুর এইচ মনসুর বলেছেন, আত্মসাৎ হওয়া অর্থ শনাক্ত ও তা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ১১টি যৌথ তদন্ত টিম গঠন করেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মতিউর রহমান শেখ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবার ও দশ শিল্প গ্রুপের অর্থপাচারের তদন্তে যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে সেখানে দুদক এনবিআর এবং সিআইডি যৌথভাবে তদন্ত করবে।
তিনি বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারী দুর্নীতি এবং মানিলন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ত থাকলে সেটির অনুসন্ধান- তদন্ত দুদক করে থাকে। এমনিতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক বা সরকারি কমকর্তা কর্মচারী ছাড়া অন্য যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততরার অভিযোগ সিআইডি তদন্ত করে থাকে। এই টাস্কফোর্সের আওতায় যেসব অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত হবে তার নেতৃত্ব দেবে দুদক।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দিন দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার সাবেক উপদেষ্টা জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র্র প্রবাসী। আর রেহানার মেয়ে টিউলিপ যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। যুক্তরাজ্যে থাকা তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান সম্প্রতি আলোচনা আসেন সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়ে তোলপাড় শুরু হলে। টিউলিপকে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়।
সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খান কয়েক দশক ধরে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা।
আরামিট গ্রুপের কর্ণধার সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে অবস্থানের খবর এসেছে। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম (এস আলম) দেশের বাইরে থাকার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
তবে ক্ষমতার পালাবদলের তার পরিবারের অন্যদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বসুন্ধরা, নাবিল, ওরিয়ন, জেমকন ও সিকদার গ্রুপের মালিকদের কাউকেও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন ও নাসার মালিকদের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল-সিআইসির অনুসন্ধান শুরুর খবর আসে।
ডিসেম্বরে দুদকের বরাত দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ‘উন্মুক্ত সূত্র’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের ‘আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে।