পাচার অর্থে বিদেশে বিনিয়োগ টি কে গ্রুপের

কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করে বিদেশে ব্যবসা গড়ে তুলেছেন ভোগ্যপণ্য খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের গ্রুপ পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার ও তার পরিবারের সদস্যরা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আমদানি-রপ্তানিতে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তারা এই বিপুল অর্থ বিদেশে সরিয়েছেন। পাচার করা অর্থে বিভিন্ন দেশে বাড়ি, ভিলা, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন তারা। পাশাপাশি বিদেশে নতুন ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন এবং গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। সব কিছু প্রকাশ্যেই করলেও, সেই ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফার এক টাকাও দেশে ফেরত আনেননি।

টি কে গ্রুপের স্বত্বাধিকারীর বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা এখন খতিয়ে দেখছেন কোন দেশে কত পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এবং সেই বিনিয়োগের অর্থের উৎস কী ছিল। পাশাপাশি, সম্পদ সৃষ্টির পুরো প্রক্রিয়া নিয়েও বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।

অভিযোগে উঠে এসেছে, টি কে গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার এবং তার ভাইবোনরা সিঙ্গাপুরে একাধিক অফশোর কোম্পানির মালিক হয়েছেন। ‘এইচপিআর শিপিং পিটিই’ নামের একটি কোম্পানিতে মুস্তাফা হায়দারের শেয়ার ৫০ শতাংশ, আর বোন ফারজানা আফরোজ ও রিজওয়ানা আফরোজ বিনতে কালামের রয়েছে ২৫ শতাংশ করে অংশীদারিত্ব, যা তারা ২০১৭ সাল থেকেই ধারণ করছেন। তিন ভাইবোনের সবারই রয়েছে সিঙ্গাপুরের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআরআইসিএস), যা সেখানে নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

ফারজানা আফরোজ একইসঙ্গে ‘এসইউপি এন্টারপ্রাইজ পিটিই’ নামের আরেকটি কোম্পানির মালিক, যা সিঙ্গাপুরে ই-কমার্স ও পাইকারি ব্যবসা পরিচালনা করে। তার স্বামী আসিফুর রহমান ‘আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’-এর একজন স্বতন্ত্র মালিক ও সহ-পরিচালক।অন্যদিকে, মুস্তাফা হায়দার ‘সামুদা ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড’-এর পরিচালক এবং ‘প্রিমিয়াম সিমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান। তিনি আরও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সামুদা রাসায়নিক কমপ্লেক্স, সামুদা পাওয়ার, সামুদা কস্টিক এবং সামুদা পেরোক্সাইড লিমিটেডে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সব বিদেশি বিনিয়োগ কার্যক্রমের জন্য টি কে গ্রুপ কোনো সরকারি অনুমোদন নেয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের ভোজ্যতেল আমদানিতে শীর্ষস্থানে থাকা টি কে গ্রুপ ও তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। তার ভাষ্যমতে, বিশ্ববাজার থেকে শিল্প সুবিধার আওতায় বেসরকারি খাত প্রতিবছর গড়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করে, যার মধ্যে টি কে গ্রুপ একাই ৮০ শতাংশ আমদানি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি শিল্প সুবিধা নিয়ে আমদানির সময় সম্পূর্ণ কর পরিশোধ না করে, ট্যাংকে সংরক্ষিত তেল খালাসের সময় ধাপে ধাপে কর পরিশোধ করে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, টি কে গ্রুপ আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। এই অর্থের বড় অংশ মালয়েশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বিদেশে অন্যদের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে সেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকে জাল বা ভুয়া নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাগজে বেশি দামে ও অধিক পরিমাণে পণ্য আমদানির কথা দেখিয়ে বাস্তবে কম দামে ও কম পরিমাণ পণ্য আনা হয়েছে। ফলে দামের অতিরিক্ত অংশ বৈধ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমেই পাচার করা হয়েছে। বর্তমানে টি কে গ্রুপ স্থানীয় বাজারে ‘পুষ্টি’ ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করে থাকে।

টি কে গ্রুপের ব্যবসা বহুমুখী। ভোগ্যপণ্য আমদানি ও বিপণনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে তেল পরিশোধন কারখানা, স্টিল মিল, পেপার ও বোর্ড মিল, পোশাক উৎপাদন কারখানা, প্যাকেজিং ও কনটেইনার পরিবহন, চা-বাগান, জাহাজ নির্মাণ এবং শেয়ার ও স্টক ব্রোকারেজসহ প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান। গ্রুপটি পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল উভয়ই পরিশোধিত ও অপরিশোধিত রূপে আমদানি করে থাকে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল দেশে এনে প্রক্রিয়াজাত করার পর বাজারে ছাড়া হয়। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি ও ব্যবহার হয় পরিশোধিত পামঅয়েলের। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রধানত পামঅয়েল এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আমদানি-রপ্তানির সুযোগকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। এসব অর্থ দিয়ে তারা বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলেছে এবং প্রকাশ্যেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। এরই মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। তিনি জানান, বিগত সরকারের সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান নানা বৈধ ও অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। পাচার করা অর্থ বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে বৈধ করে কাঙ্ক্ষিত দেশে নেওয়া হয়েছে এবং সেখানেই তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অথচ এ মুনাফার এক টাকাও দেশে ফেরত আনেনি। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!